17 Dec, 2016 * Editor: Dipankar Dutta * Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in * Mobile: 9891628652 * Delhi

Dipankar Dutta is no more. We pray that may his soul rest in peace.

বই কথা কও : পীযূষকান্তি বিশ্বাস

পাঠকামি- ১৬
  
আজ এমন একটি বই নিয়ে বসেছি, বলা যায় অনেকগুলো বইয়ের সমাহার। কাঁচাপাকা বয়স মিলে লেখা এই কবিতাগুলি বহুদিন ধরে দিল্লির বিভিন্ন আসরে আমি পড়তে শুনেছি। কবির সাথে ব্যক্তিগত ভাবে কোনও পরিচয় ছিলো না, কিন্তু কবিতার সাথে কবিতার জন্যই একদিন বোধহয় জানা পরিচয় হয়ে যায়। পশ্চিম দিল্লির এক বাঙালি কলোনী মহাবীর এনক্লেভের নাট্যব্যক্তিত্ব বিদ্যুৎ মুখার্জীর মুখে প্রথম এই কবিতাটি শুনি -  

"তোমাকে লেখা হলো না সাহারানপুরের চিঠি
শেরশাহী আমলের বেড়ে ওঠা অশ্বত্থ চূড়ায়
                    বাতাবী লেবুর মত চাঁদ
পাঠান না হবার দুঃখে 
                    বৃক্ষের শরীরে তার
                    শীলমোহর দৃশ্যমান নয় ..."

গায়ে কাঁটা দিতো। উচ্চারণটা এমন নাটকীয় ভাবে বিদ্যুৎদা করতেন, গ্র্যান্ড ট্রাংকরোডের চিত্রে ভরে যেত প্রেক্ষাগৃহ। দিল্লির অন্যতম সেরা বাঙালি কবি গৌতম দাশগুপ্তের সাথে দিল্লি হাটের এক কবিতার আড্ডায় পরিচয় হয়। ধীর ও স্থির এক নিমগ্ন কবি এই গৌতম দাশগুপ্ত লিখে চলেন ভাষা ও ভৌগলিক সীমানার বাইরের কবিতার কথা। তার কবিতার সমগ্র এই বছর পাঠক থেকে বেরিয়েছে। আমাকে উপহার স্বরূপ যখন দিলেন, আমি আগাগোড়া পড়ে ফেলার সুযোগ পেলাম।  বইটা হাতে তুলে ধরিঃ
  
কবিতা সমগ্রঃ গৌতম দাশগুপ্ত 

বইটা হাতে নিলে একটা নস্টালজিয়া কাজ করে। অপরিচিত কবি হঠাৎই চেনা হয়ে যায়। ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে যান। বলতে হবে খুব যত্ন করে বইটি করা, বোলে তো দিল লাগাকে, মনের ভিতর থেকে উঠে আসা পংক্তিগুলো পাঠককে এক দারুণ আবেশের কবলে নিয়ে যায়, একটা যাদু কাজ করতে থাকে, যারা পোস্টমর্ডান কবিতা নিয়ে কাজ করেন তাদের কাছে এ কবিতা এক সোনায় সোহাগা। কবিতাগুলি পূর্বপ্রকাশিত বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।  স্বাদ চাখনা চালু করা যাক।

"যতই আমি রৌদ্রোজ্জ্বল পিতল দ্যাখার করি বায়না
তিস্তামণির স্রোতের মতোন দিন চলে যায়।"                (দিন চলে যায়)

বিশেষ্য ও বিশেষণের এমন কোঅর্ডিনেটেড প্রয়োগ কবিতায় এমন এক মাত্রা আনে, পাঠক টান টান হয়ে বসে। দিন তো চলেই যায়, যৌবনের দিনগুলো বহুদিন আগে চলে গেছে। গৌতমদা তবুও আজ যে কোনও সময় ডাক দিলে দিল্লি হাটে কবিতা পড়তে আসে। কবিতার কাছে মাথা নত করে বয়স, গৌতমদা পড়ে চলেন-

"স্বামীর সন্দেহে
রাগমোচনের মতো নিচে পড়ে জেলিফিস
জলের শাবক ক্যাটরিনা
        কিন্তু
সমুদ্র চিনল না"             (চিনল না)  

এমন কবিতা কদাচিৎ মেলে। দিল্লির এমন এক রুক্ষ প্রদেশ, পাথুরে জমি সেখানে বীজ গেঁড়ে দিয়ে বাংলা ফুল ফুটিয়ে নেওয়া, যেন তেন মালীর কাজ নয়, বুকের মধ্যে তুফান উঠে এলে এক বিদ্যুৎ চমক মেলে, পাহাড় ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে গৌতম দাশগুপ্তর মত কবি। আর যারা সমুদ্র চিনল না, তাদের ফেনা সর্বস্ব জীবনে অনেক ঢেউ আসবে হয়তো... কিন্তু এই কবিতা, আহা, চমকে চমকে উছলে বালুভূমি অব্দি উঠে আসে।

"আমার নাড়ির তন্ত্রে টান পড়ে উপরে তাকাই
পিতৃলোক বিদ্যমান আর্যরক্তের দাবি নিয়ে
সাজানো অ্যান্টিক থেকে তুলে নিই বাঁকা তলোয়ার
তথাস্তু ভঙ্গিতে হাতে কৃষ্ণযজুর্বেদ
কোন প্রাজ্ঞ গুরুজন"                             (আর্যরক্তের দাবি নিয়ে)

একটা ইতিহাস খোঁজা চলে। সারাজীবনই চলে জীবনের উৎসের খোঁজ। বাংলা সাহিত্যের খোঁজ চলছিলো দিল্লির বঞ্জর জমিতে, তখন বোধহ্য় আশির দশক, পোস্টমর্ডান কবিতার চর্চার এক স্বর্ণযুগ। দিল্লির বাংলা সাহিত্য নিয়ে যতবার লেখা হবে, গৌতম দাশগুপ্ত, অরূপ চৌধুরী ও দীপঙ্কর দত্ত-র কথা ঘুরে ফিরে আসবে। এমতাবস্থায়, যে কেউ নিজের রুট খুঁজতে খুঁজতে আর্যরক্তের সন্ধান পাবে না কে জানে ? তবে এটা নিশ্চিত অধুনান্তিক বাংলা কবিতার অতি এক উত্তম অধ্যায় যে গৌতমদা যাপন করে এসেছেন এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

"আমার আকাঙ্ক্ষা প্রেম-কাম
উথলে উঠলো আর গন্ধকের ধোঁয়া
চেটেপুটে নিয়ে            শেষ সন্ধ্যা রেখে গেছে
কেঁদোনা লক্ষ্মীমেয়ে শীতের বিষাদ সন্ধ্যা
পতঝর দুঃখই বাড়াবে"                           (বারুদ সংহিতা)

গৌতমদার কাছে শুনেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ওনাদের বাড়ি আসতেন। বড়দা কবি অমিতাভ দাশগুপ্তের বন্ধু ছিলেন। গৌতমদার লেখায় এমন বিষাদের কথা এত রোমান্টিক ভাবে বোধহয় শক্তিই লিখতে পারতেন। দিল্লির কবি বলেই হয়তো প্রচারবিমুখ গৌতমদা কোনো বিশেষ পরিচিতি আজও পাননি বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্বাস আর গাঢ়তর হয়, এ হেন মানুষটি আজো ফেসবুকে আসেন নি।

"যুদ্ধের অনন্ত স্লাইড দ্যাখাতে দ্যাখাতে আমি ভুলে গেছি প্রিয়
বসরার রাস্তায় একটি গোলাপ কাল জ্বরে
ছোঁবার আগেই তার আর্তনাদ দীপ্ত বরণীয়
টোমাহক পারদে দ্যাখো ঢেকেছে যুগল স্তন
এর চেয়ে ভালো ছিলো সাদ্দামের গৃহ ..."                   (আরবের ছবি)

রোমান্টিক কবির আর এক রূপ আমরা দেখতে পাই ফুঁসে ওঠা গৌতমদার মধ্যে। আধুনিক কবিতাকে আরো এক লেভেলে নিয়ে গেছেন। একথা আমার নিজের উপলব্ধিই নয় বেশ কিছু কবির কাছে এরকমই আমি শুনেছি। রাজনৈতিক পটভূমিকে এক লহমায় গতি দিয়ে দেন, কবিতা হয়ে ওঠে শিল্পের মূর্ত আখ্যান। চাঁদ, পাতা, নদী, ফুল মালার পরিবর্তে এ কবির কলম ঢের বেশী বারূদে অভ্যস্থ। 

"দেওয়ালের ক্যালেন্ডারে
উত্তাল অ্যাটলান্টিকে ময় ছিলাম
চটকা ভেঙে ভেসে উঠল ডানকার্ক অবরোধের এক স্টর্মট্রুপার
ভেজা দাড়ির লতা গুল্মে
দু একটা বাচ্চা পোলিশ কাঁকড়া পথভ্রান্ত
ডেজার্ট ফক্সের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া কার্তুজে
ব্যাচলগ্ন ভিকটোরিয়া ক্রশ ..."                         (শূন্যকাল)

চিরাচরিত কবিতার চলন ভেঙে দুমড়ে ফর্মের সাথে মিশিয়ে দেন সূক্ষ্ম রস, ভাষাকে ডিসটর্ট করে গড়ে তোলেন নিজের সাক্ষর, 'জিরো আওরার'-এর দিনগুলোকে যাপনের আলোয় এনে বিশ্লেষণ করে বর্তমান পৃথিবীর সময় জিজ্ঞাসা। বলা যায় এমন পাওয়ারপ্যাক কবিতা নেওয়ার মত বাংলায় পাঠক প্রায় নেই। নিম্নমেধার পাঠকরা যে তুলতুলে মিষ্টি প্রেমের গল্প খুঁজবেন, সর্বহারা মিল শ্রমিক যে প্রতিবাদী আওয়াজ খুঁজবেন, তা তিনি পাবেন না। রাজনীতিকে এত সুকৌশলে শিল্পের দোরগোড়ায় যে তিনি নিয়ে আসতে পারেন তার প্রধান কারণ তিনি নির্বাচন কমিশনে কাজ করার দরুন অজস্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখী হয়েছেন।     

আর একটি উদাহরণ দিতেই হয়। তারমত করে পৃথিবীর এই সব আন্তর্জাতিকতার কবি ডায়াস্পোরিক চিন্তাভাবনা জগতের।  

"গ্লোবাল পাল
কাঞ্জিভরম থোক থেকে ছুঁড়ে মারে
মানহাটন প্রজেক্ট
ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলা
স্ট্যালিনের রাত
হিরোসিমা বৌভাতের তত্ত্ব।"          (কাঞ্জিভরম থোক থেকে)

পোস্টমর্ডান কবিতাকে গৌতমদা আমেরিকায় নিয়ে গেছেন, পৌঁছে দিয়েছেন জাপানের আর্তি, প্রাচ্যের কান্নার সাথে সাথে বঞ্চনার ইতিহাসকে বার বার সাবজেক্ট করেছেন, একজন সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের কবির কাছে আমাদের নতজানু হয়ে কবিতা পড়া ছাড়া কিছু থাকে না ।

"কার জন্য ভাবছেন 
কাল পরশুই ঠিক
এসে যাবে ফোন
একটা আকর্ষণ থাকে
ফনফনে চারার মতো
থাবা শক্ত হয় ডায়ালের
পুজো আসছে
আসছে স্ট্যামপেড।"          (থাবা শক্ত হয়)


গৌতমদা ভালো আছেন, কবিতায় আছেন, মাঝে মাঝে পাঠকের দেরী হয়ে যায় কবিকে চিনতে কিংবা পাঠক নিজেই বঞ্চিত হন। গৌতমদা দিল্লিতে কবিতা অন্তপ্রাণ আদ্যপ্রান্ত প্রবাসী কবি হয়ে কাটিয়ে দিলেন। এই বইটি "পাঠক" পাব্লিকেশন করে নিজেরাও বোধহয় সম্মানিত হলেন। বইটি প্রকাশ হয় কলকাতা বইমেলা ২০১৬ তে। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে আমার নিজেরই গর্ব অনুভব হচ্ছিলো।















কবিতা সমগ্র, গৌতম দাশগুপ্ত, পাঠক প্রকাশনী, মূল্য : ১৫০ টাকা
₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪


পাঠকামি- ১৭       

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে আমার আগের পরিচয় নেই। বইমেলায় কোনদিন দেখা হয়েছিল হয়তো কিংবা হয়নি, কেউ মনে রেখেছে বা কেউ রাখেনি। বিস্তারিত ভাবে ফেসবুকে পরিচয়, এমন একটা দুনিয়া যেখানে নিজে যদি নিজের ঢাক না বাজান মুখ ঢাকা পরে যায়। কোন বিজ্ঞাপনই আর কাজে আসে না। মানুষ তবুও একটা বারান্দা খোঁজে, যেখানে বসে দুটো কথা বলা যায়, একটা দুটো প্রতুত্তর, কতক্ষণ আর একাকীত্বে আটকে থাকা যায়, কখনো কখনো একটা হাইফেন এখানে বসিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করার কথা ভাবি।

হাইফেন বসানো বারান্দাঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

দু একটা কবিতা বিপ্লবদার পড়িনি সে রকম নয়, পাঠের মধ্যেও তেমন পরিচয় থাকে না, কবির সম্পর্কে জানার জন্য একটা দুটো কবিতা কাফি নয়, কিন্তু এক ঝলকে এটা বোঝা যায় আর একটু গভীরে গিয়ে জানা যায়, ভিতর যানা চাহিয়ে। এই বইটি আমি ক্যুরিয়ারে পাই।

"এক পশলা গ্রামজীবন।
লম্ফ জ্বেলে কেবলই অপেক্ষা করে রাত "        (স্থানীয় ছায়া এবং)

কবিতাটি আমি আমার প্রেক্ষাপটে পড়ি। গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে আসা আলো আজ অন্ধকার কাটানোর কথা বলেন কবি। একটা অন্ধকার কাটানোর জন্য একটা ল্যাম্পই যথেষ্ট। অল্প প্রয়াস, সে আলোয় কিন্তু দিব্বি দেখা যায়।  একটা রাত আসে তার পর, খানিকটা গ্যাপ দিয়ে, তখন বোধহয় সব লম্ফরা ঘুমাতে যায়, গ্রাম জেগে থাকে...শহর বোধ হয় গ্রামকে মুছে দিতে পারে না, বহু শতাব্দী ধরে এভাবেই গ্রাম জেগে আছে।

"মরচে ধরার ভয়ে
গোপন পেরেক ক্ষত সম্পাদনাহীন "    (মাধ্যাকর্ষণ)

বিজ্ঞরা বলেন, যেন কবি নিজেই এক একটা বিষয়। সুতরাং কবি নিজেকে নিয়েই লিখবেন। তাই নিজেকে শান দিতে চান যে কোন কবি, সে এত তাড়াতাড়িই আউটডেটেড হয়ে যেতে চায় না, যে কোনও ভাবে মেলে ধরতে চায় প্রতিভা। বিপ্লব দা লেখেন যে, প্রচার কৌশল বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।  কবিরা মেতে ওঠে 'আমরা' 'ওদের' খেলায়। কিন্তু আদতে তারা কবি হতেই চেয়েছিলো, এখানেও একটা গ্যাপ দিয়ে কবি কথাটা বলেন, গ্যাপটা একটা বিরতি। তার বোধোদয় মনে হয় একটা ব্রেকের পরে আসে।

"গোলকত্ব আর ঝর্ণাজলের নিশ্চয়তা
থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে প্রাসঙ্গিক জিজ্ঞাসাবাদ
মাঠ থেকে গড়িয়ে যাচ্ছে ফুটবল"                   (ঝর্ণাজলের নিশ্চয়তা)

এমন একটা বিষয়, প্রশ্ন না ওঠাই স্বাভাবিক। যে বল গড়িয়ে যায় তার আয়তন নিয়ে কে আর ভাবে, বলটা কিভাবে গোল হয়ে যায় ? মাঠ থেকে দৃশ্য মূলত উধাও। একটা পৃষ্ঠটানে জলের এক একটা বিন্দু টপ টপ করে পরে, সে কি আয়তন নেয় ? আর একটা প্রশ্ন উসকে দেয় অন্যের কোর্টে বলটা আমরা ফেলছি না অবিরাম ? কবিতাগুলো কবির মুখ হয়ে উঠেছে।

"বাইদ বহাল। কৃষিজমি। উঠোন পেরিয়ে
দূরে লাঙলের ধারালো ইস্পাত।
ছুড়ে গেলে আগাছা জঞ্জাল। সবুজ ব্রা
নুন গন্ধ। সুঠাম মাঠ। আধখোলা মাঠ।"         (স্নাতকের লিরিক্যাল হাত)

এটাই এই বইয়ের সেরা কবিতা মনে হলো। কবিতা লিখতে গিয়ে দেখেছি এক জন্মের ইচ্ছা কেমন চাষ আবাদের কথা বলে। সৃষ্টির আগ্রহ পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যায়, তার চোখে যা কিছু প্রিয়, যা কিছু আপনা, বড় কোমল ও আদরনীয় মনে হয়। মনে হয় কে যেন ডাকছে প্রতিদিন, মাঠ শুয়ে থাকে, শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ার আমন্ত্রণ, একটা ইশারার অপেক্ষায় থাকে। ভিজে উঠতে চায় যে কোন কবি, যে কোন পাঠক। কবির আশাবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাব্য-দর্শন কে দৃঢ়তা দেয়।

"এক সময় আলো এসে পড়ে
কথা বলতে বলতে থেকে যায় ঝাপসা দৃষ্টি
সহজ মুদ্রায় কিছু সোনালী বিভ্রম
ঝুল জমতেই থাকে
    জমতেই থাকে "                            (হাইফেন বসানো বারান্দা)

এ রকম অনেক কবিতা পড়ি। কবিতা পড়িয়ে নেয়। এক নতুন শৈলী আছে। বোঝার আছে। ভাবনার আছে। কতকিছু আমাদের টানে, কবি তার সাথে আমাদের যোগাযোগ করিয়ে দেন, নিমগ্ন পাঠের ভিতর ডুবিয়ে দিতে বলেন মন।  নিজেকে ধুয়ে মুছে আবার দাঁড় করিয়ে নেয় কবি, আয়নায় দেখতে পান, আমাদের দেখান, বুকের ভিতর ঝেঁকে দেখতে ইচ্ছা করে আবার।

আরো অনেক কবিতা পড়া যায়, এপিসোড, খেলাঘর, আকাশ ক্যাম্পাস, অসুখের রাফখাতা, আলো-টোন, রাতের কার্তুজ, অলীক বাইপাস। কবিতাগুলি পড়ে মনে হয়, কবি তার অভিজ্ঞতার এক সিরিয়াস ঝুলি পাঠকের দরবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এক নতুনতর কবিতা উপস্থাপন করে চলেছে। বিপ্লবদার হাতে আরো কিছু অচেনা মানুষের কথা, যাপনের দিন রাত্রির কথা উঠে আসুক, উদ্ভাসিত করুক কবিতাকে যা নিয়ে এ রকম আরো অনেক নিরীক্ষা স্থায়িত্ব পাক, কবিতা কথা বলে উঠুক।















হাইফেন বসানো বারান্দা, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, পাঠক প্রকাশনী, মূল্য ৮০ টাকা 
₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪


পাঠকামি- ১৮

বই সংগ্রহ করতে করতে পাহাড় হয়ে ওঠে। সুখ পাহাড়। কোন একদিন পড়বো, এমন ভাবনায় ডুবে থাকে বইগুলো একে অপরের বুকে মুখ গুঁজে। পাঠকের প্রিয় ছোঁয়া কেউ পায় কেউ বা কেজি দরে বিক্রি হয়ে যায়। কিছু বই পড়তে দেরী হয়ে যায়। কিছু বই পিরামিডের মত জেগে থাকে, মানব সভ্যতাকে বুকের উপর উচিয়ে থাকে, পুরুষতন্ত্র সেদিকেই তাকিয়ে থাকে, কমনীয় বুকের কাছে সুকঠিন পোস্টমর্ডানিটি বিছিয়ে রাখে ভবিষ্যৎ। নারীও এগিয়ে আসে বলশালী এক উচ্চারণ নিয়ে। নিজের অজান্তেই সেও এক তন্ত্র হয়ে ওঠে। এই ম্যাজিকের মধ্যের সের স্যুররিয়াল উপমাগুলি ঠিকরে বেরিয়ে আসে চৌরেখাবতীর মত, একটা আলোক ছড়িয়ে পড়ে। তাকে বিস্তৃত ভূমি ফেলে ধরতে হয় নইলে এক লক্ষ ছিয়াশী হাজার বেগে শূন্যভেদ করে সে এগিয়ে যায়। আজ যে কবিতার বইটি আমি পাঠ করছি, সেটি কলকাতা বইমেলা ২০১৬ এ কবিতা ক্যাম্পাস থেকে সংগ্রহ করা। আমাকে লিখে দিয়েছিলেন "পীযূষকে অফুরান আহ্লাদে" দেবযানী বসু। দেবযানী বসু আমাদের এই সময়কালের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি।

দেবযানী বসুঃ চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা

কবিতার কাছে এসে এই মনে হয় তার ভাষা থেকে কিছু রহস্য উড়ে গেলো। কিছু লুকানো ছিলো অতীত, তাকে ধরতে চাওয়া কিছু আকাঙ্ক্ষা, কিছু বা উন্মোচিত করতে চাওয়া অবচেতনা। এমন এক সংজ্ঞা ঘেরা টোপের সুতো কেটে বেরিয়ে এসে দেবযানীর এই কবিতা যাপন দেখে সত্যি আহ্লাদিত হতে হয়। ঠিক বলেছিলেন কবি।

"বনে হারিয়ে
যাওয়া টিউব-শিশু টবে চাষ করি। পার্বতী নারীরা গাছটিকে
ওয়াট অ্যাপে নেয়। ওদের এস সি এস টি। ওদের মাদাম
বোভারি"                                                 (কবিতা ২)

চার বা পাঁচ লাইনের কবিতা। গদ্য। হাত পা গোটানো। হাভাতে নয়। নামহীন এই কবিতারা অচেনা এক কবিকে এক নাম দিতে চায়।

"প্রেমিকা বেহাত হচ্ছে দেখতে আম ল্যাংড়াই থাকে। ল্যাংড়া
আম তবু নেতার নেতা। গুজব সমপ্রসারণশীল জোঁক
সোডিয়ামে আরামে তা বেড়েই চলেছে।"                    (কবিতা ২৩)

কিছু কথা মাথায় থাকে, কিছুটা বলা হয়, কিছুটা পংক্তি বেয়ে চলে আসে। আগত ভাষার মধ্যে জারিত হয় চেতনা। কবির মুন্সিয়ানা এখানে অবধারিত হয়ে চলে আসে। 'ল্যাংড়া' শব্দটা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় বাক্যবন্ধের বাঁকবদল। এমন শক্তিশালী লেখনীর জন্য অনেক তৈরী হতে হয় কবিদের।

"ফকিরের কাঁচা বুকে ভিয়েন এক ঝাঁক চরকি আলো
হাজমোলার গন্ধে মাতাল। লকেট ও মথের ঘনত্ব।
গিটার গায় ঘরোয়া সুইমিংপুলে। নাভি কোমল নি।        (কবিতা ২৮)


বেশ চমক লাগে এই সব কবিতা পড়তে। মাথায় ঝনঝন করে ওঠে। কয়েকটি ট্র্যাক একসাথে চলছে কবিতায়। কবিতার চলন ধরতে ধরতে লাইন শেষ হয়ে যায়। নতুন আবিষ্কারের নেশা বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের খেলা আর হঠাৎ ট্রাক স্তব্ধ হয়ে যাওয়া। 'নাভি কোমল নি' এমন ভাবে কবি প্রয়োগ করেন যে পিয়ানোর প্রত্যেকটি রিড এক সাথে বেজে ওঠে।

"বাঁ দিকে লাল নৌকাদের নাচ
ডান দিকে কমলাবাসের নাচ সিগনালে আটকান গাড়ির
চারপাশে মৌমাসিদের নাচ ঘড়ির দমবন্ধ বিরিয়ানি"         (কবিতা ৩৩)

মনের সব কথা সব সময় বলে বোঝানো যায় না। ইশারা করতে হয়। এমন বহু দম্পতিকে দেখেছি যারা কোনদিন একে অপরকে আই লাভ ইউ বলেনি। ঠিক সেরকম কিছু কিছু কথা ইশারায় ও বোঝানো যায় না, তাই তাকে উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হয়। ভালো কবি ভালো কবি হয়তো উদাহরণ দেওয়া কঠিন, কিন্তু এই যে অসমম্ভব পংক্তিমালার বহুরৈখিক বিকাশ কবি দেবযানী বসুর কলম হয়ে বেরিয়ে আসে, বলতেই হয় হ্যাটস অফ। 'মৌমাসি' আর 'দমবন্ধ' দুটি শব্দ পাঠককে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় জ্যাম লাগিয়ে আটকে দিতে পারে। এখানে অবচেতনা, ইশারা, রূপক, উদাহরণ ও বহুরেখা এক বিন্দুতে এসে একত্রিত হয়েছে।

"প্রতিটা শ্রমিক পিঁপড়ের সমকাম দেখি। যুদ্ধাস্ত্রের ওয়ার্কশপে
বিপ্লব বলে কোন অস্ত্র নেই / স্কুল বাসে সামোসা খাবার
প্রথা রদ করবে না কেউ"                                      (কবিতা ৪৮)

শব্দের বিচরণভুমিতে কবি গেড়ে দেন অস্ত্র। মন-আবেগ-মেধা পরস্পরের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বহুরৈখিক ভাবে সেই লড়াই চলে, কবিতার কোন উপসংহার টানেন না কবি। বিপ্লব বলে কোন শেষ কথায় বিশ্বাস নেই তার। বরং বোঝা যায় তার এক রমনে ইচ্ছা, যা বহুদিনে অতৃপ্তির কথা মনের কোনে কোনে জমে আছে, যা কোনদিন হয়তো আবিষ্কৃত হবে বলে। অতি সুন্দর কবিতা, তা গঠন দিয়ে, ভাষা দিয়ে, অতীত দিয়ে গঠন করা। পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়।

আসলে প্রত্যেকটি কবিতা নিজের নিজের থেকে আলাদা আর অতি যত্নে লেখা। একটা কবিতা যেন অন্য কবিতাকে ছাপিয়ে যায়। আলাদা চলন, ভাষার অনন্য বাবহার, বিষয় বিবেচনা লাইন থেকে লাইনে বিভিন্নতা আনে। সমসাময়িক কবিদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট দারুণ জনপ্রিয়। নিসন্দেহে কবি দেবযানী বসু আগামী দিনেও এরকম কাব্য প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়ে বাংলা ভাষার খাজানায় নিজের যোগদান স্পষ্ট করে তুলবেন।















চৌরেখাবতী পিরামিডের অরোরা, দেবযানী বসু, সুতরাং প্রকাশনী, মূল্য ১০০ টাকা 
₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪₪