17 Dec, 2016 * Editor: Dipankar Dutta * Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in * Mobile: 9891628652 * Delhi

Dipankar Dutta is no more. We pray that may his soul rest in peace.

কথোপচারণ: অমিতাভ মৈত্র, প্রশান্ত গুহমজুমদার, উমাপদ কর

শিক্ষা, জীবিকা, কর্ম নিবৃত্তি, বিবাহ, চিকিৎসা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দাঙ্গা, অপরাধ, অত্যাচার, বিভাজন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে যুগে যুগে মানুষের স্থানান্তরণ হয়ে এসেছে। সঙ্ঘারাম ভেঙে যায়, সতীর্থদের প্রিয় মুখগুলি হারিয়ে যেতে থাকে। অন্য কোথা অন্য কোনোখানে বেগে ধাওয়ার তাগিদে, নতুন তল্লাটে আশিয়ানা নির্মাণ ও অভিযোজনের তাগিদে বহু পূর্বস্মৃতি ধূসর হয়ে আসে। এই কথোপচারণের কুশীলবরা আর পাঁচজন মানুষের মতো সমাজবদ্ধ প্রাণী হয়েও অসাধারণ এই অর্থে যে তাঁরা কবি এবং কবিতার স্বার্থে, জৈবনিক তাবৎ কাব্যিক কর্মকাণ্ডের উপজীব্যতার স্বার্থে নিয়ত রোমন্থন প্রক্রিয়ায় স্মৃতিকে সজীব রাখাই তাঁদের ধর্ম। কলকাতা থেকে উমাপদ কর ও মালদা থেকে প্রশান্ত গুহমজুমদার, প্রায়শই নিজের পৈতৃক ভিটেয় আসা যাওয়া করেন, কিন্তু বহরমপুর ওরিজিনের এই দুই কবিকে তাঁদের নিজের শহরেই কবি অমিতাভ মৈত্র মহাশয়ের সঙ্গে একাট্টা করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আড্ডা জমানো শুরুতে সহজ কাজ মনে হচ্ছিলো না দূরে বসে। কিন্তু শেষ তক শেষ রক্ষা হলো। মিতবাক অমিতাভ মৈত্র, প্রশান্ত গুহমজুমদার এবং উমাপদ কর বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদ সহ পশ্চিমবঙ্গের সাতের দশক থেকে এ সময় পর্যন্ত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক, শিল্প সাহিত্য বিশেষত কবিতা, কবিতা-চর্চা ও লিট্‌ল ম্যাগাজিন বিষয়ে অবস্থা অবস্থান রূপ রূপান্তর স্বতঃস্ফূর্তভাবে, খোলা মনে, গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যসহ যেভাবে আড্ডা ও আলোচনায় এনেছেন, ইয়াদোঁ কি বারাতের যে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করেছেন, তার জন্য তিনজনেই শাবাসীর হকদার। - দীপঙ্কর দত্ত 














(আড্ডা। আলোচনাও বলা চলে। দুই পর্বে। স্থান বহরমপুর। ১৩/১০/২০১৬ সন্ধ্যা ৭-৩০ থেকে ১০ টা এবং ১৪/১০/২০১৬ সকাল ১০-৩০ থেকে ১-৩০। অংশগ্রহণকারী – অমিতাভ মৈত্র, প্রশান্ত গুহমজুমদার ও উমাপদ কর। আড্ডায় উঠে আসে বহু বিষয় মূলত বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদের শিল্প সাহিত্য কবিতাচর্চা রাজনীতি সামাজিক অবস্থান এবং লিটল ম্যাগাজিন। এছাড়াও আরও সব, ওয়েব-ব্লগ-ম্যাগ, মিডিয়া, প্রতিষ্ঠান, পাঠক, সাহিত্যের উদ্দেশ্য ইত্যাদি। আড্ডায় বহু কথা। বিশালাকারের কথা ভেবে কিছু বাদ, কোথাও সংক্ষেপিত, তারই লেখ্য-রূপ।)


উমা- কতদিন পর যে আমরা এভাবে এক জায়গায় মিলে দুটো কথা বলবো, তা বোধহয় আর মনেই পরে না। সেই কলেজ লাইফে তোমাদের সঙ্গে পরিচয়। আমাদের ‘শ্রাবস্তী’ পর্ব। কবিতা নেওয়া ছাপানো। ১৯৭২-৭৩। কত গল্পগাছা, কবিতা শোনা, আড্ডা, ব্যক্তিগত কথাবার্তা। তোমরা দুজন তো তখন আমাদের কাছে আইডল। মনে তো আছেই তোমাদের। কিন্তু তোমাদের আরেকটু আগেরটা বলো না। লেখালিখি, কবি সাহিত্যিক, বহরমপুর, পরিবেশ পরিমণ্ডল, রাজনীতি, পত্রপত্রিকা, এইসব আর কি!

অমিতাভ- কী যে বলো! আমরা দুজনওতো তখন শিখছি। আমার তো হয়ই না। প্রশান্তর কিন্তু হতো। ও তো ক্লাস সিক্সেই 'পাগল' বলে একটা গল্প লিখে ফেলে। ক্লাস সিক্সের ছাত্র। আমি প্রশান্তর অনেক পরে লেখালিখি শুরু করি। ও অনেক আগেই শুরু করে। আমি ভাবিই নি। ধারণাতেও ছিলো না। পরে আমি একটু আধটু। কিন্তু তখন ও যে কী করে আমি জানি না বা আমি কী করি ও জানে না। 

প্রশান্ত- হ্যাঁ ও লিখত, এবং সেটা ইংরেজিতে।

অমিতাভ- (হেসে) হ্যাঁ, ইংরজিতে লিখতাম। ওই আর কি! কিছুদিন পর যখন আমাদের হৃদয় জানা গেলো, তখন অবস্থাটা পালটে গেলো। তখন আমরা ছিলাম হরিহর। সবসময় দুজন এক সঙ্গে। পাড়ায়, কলেজে, ঘোরাফেরায়। লোকে আমাদের দুজনকে বলতো শংকর জয়কিশান। তো, আমি লিখলে ও পড়ে। ও লিখলে আমি। কিছু কি আর হয়? আমি নিশ্চিত আমারগুলো তেমন কিছু দাঁড়াতো না, কিন্তু প্রশান্ত এমন কিছু লাইন লিখত, যা চমকে দিত। আজও মনে আছে। কলেজ লাইফের শুরুতে প্রশান্ত তখন প্রেমে মত্ত। হাবড়ায় এক বিয়ে বাড়িতে গিয়ে সন্ধ্যা নামে একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। একেবারে হৃদয় সমর্পণ করে চলে আসে। আর প্রচুর কবিতা লিখতে থাকে। তখন ওকে আমরা বলতাম প্রেমের দারা সিং।

উমা- কী সিং?

অমিতাভ- প্রেমের দারা সিং। কুস্তির যেমন দারা সিং ও প্রেমের। মানে প্রেমে ওকে কেউ হারাতে পারবে না। (সবাই একচোট হাসি)। তো কবিতাও তখন সেই প্রেমে মশগুল। প্রেম আর কবিতা।  প্রশান্ত কিন্তু নিজের লেখাটা প্রথম থেকেই লিখত। আমি কিন্তু তা পারতাম না। আমার মধ্যে বিভিন্ন কবির খুব প্রভাব চলে আসত। লোকে স্বাভাবিকভাবেই ভাবত, যে এই বয়সে এর কবিতা এত ম্যাচিওরড কী করে? ম্যাচুরিটির ব্যাপারটা কিন্তু সেই প্রবল প্রভাবের ফল। আমি তখন ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা পড়ছি…

উমা- (থামিয়ে দিয়ে) কিন্তু অমিতাভদা, প্রভাব কার নেই? তুমি এমন একজন কবি সাহিত্যিক শিল্পীকে দেখাও যার প্রথমাবস্থায় প্রভাব ছিল না।

প্রশান্ত- প্রভাব থাকবেই। প্রভাবটা কী? মানে ভেতরে ঢুকে পড়া। আসলে কি প্রদীপের (অমিতাভ কে ওই নামেই ডাকে) একটা ব্যাপার ছিল। ও খুব পড়ত। দেশী, বিদেশী। সব। একেডেমিকের বাইরে গিয়ে পড়ত। আমার মনে আছে, আমাদের একটা পাঠ্য ছিল, কী যেন নাম, ‘Golden Treasure’। সেটা ও গুলে খেয়েছিল। এছাড়া তখন বাংলা সাহিত্যের শক্তি সুনীল বিনয় ও সমানেই পড়ছে। তার আগে জীবনানন্দ। পড়েছে মানে, একদম মুখস্ত করে আত্মস্থ করে ফেলা। ফলে হয়ত একটা প্রভাব একটা অনুপ্রীতি জন্মে যেত। কিন্তু সত্যি বলতে কি, সে কবিতা ছিল ভীষণ ম্যাচিওরড। সেই সময় আর বয়সের তুলনায় খুব তৈরি। এটা আমরা আজ হালকা ভাবে উড়িয়ে দিতে পারি না।

উমা- আর হোত না, মানে কি! সবারইতো তৈরি হতে একটা সময় লাগে। সবারই একটা মকসো পিরিয়ড থাকে। কারো বেশি, কারো কম। আমাদের সময় সবারই মকসো পিরিয়ড ছিল বেশি সময়ের, এখন যারা কবিতা লিখতে আসছে তাদের মকসো পিরিয়ড খুবই কম। একদম তৈরি হয়েই আসছে যেন।

অমিতাভ- একদম ঠিক। এরা খুব বুদ্ধিমান। স্কোপটাও বেশি। রিসোর্সটা ভাবো। এখন লেখাপত্র পাওয়া কত সহজেই। সব কিছু হাতের কাছে প্রায় মজুত। আর আমাদের খুঁজে বেরাতে হত। কোথায় পাবো? তাছাড়া অর্থও একটা ব্যাপার। পয়সাকড়ি ছিল না তো। আমি আর প্রশান্ত পয়সা জমিয়ে বই কিনতাম। দুজনে একটা বই। তাতে একটু সুবিধে হত। 

উমা- আমার তো লাইব্রেরী ভরসা। আর ওই যা প্রাইজ টাইজ পেতাম। আবৃত্তি, বিতর্ক, এক্সটেম্পো ওসব করতাম তো। তাতেও প্রচুর বই প্রাইজ পেতাম। ওই বইএর নেশায় অংশগ্রহণও করতাম খুব।

অমিতাভ- ৭১-৭২ হবে, আমি দেশ এ একটা কবিতা পড়ি। ‘চন্দন কাঠের বোতাম’ সুনীল গাঙ্গুলির। একটা দীর্ঘ কবিতা। সেই দেশ-এর প্রচ্ছদটাও আমার মনে আছে। সেটাই পাঠ্যের বাইরে আমার প্রথম কবিতা পড়া।

প্রশান্ত- কোনটা? ভ্রুপল্লবে ডাক দিয়ে গেলে…

অমিতাভ- না না। ওই তো যেখানে যেখানে দিয়ে ছিল। সে সময় প্রশান্তর বাড়িতে দেশ বাঁধাই করে রাখা ছিল। সেখানে তখন পড়তে লাগলাম বটকৃষ্ণ দে, রাজলক্ষী দেবী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত। আরও সব। বুদ্ধদেব বসুর সমুদ্র বলে একটা, ওই ‘Old man and the Sea’ র মত। এইসব। তখন আমরা একটা পত্রিকায়, নাম ভুলে গেছি, দুজনে কবিতা পাঠালাম। স্ট্যাম্প ট্যাম্প মেরে পাঠিয়ে দিলাম। তাড়াতাড়িই উত্তর এলো। হ্যাঁ কবিতা ছাপানো হবে। মাসিক পত্রিকা, মাঝেমধ্যেই ছাপা হবে। কিন্তু বাৎসরিক পাঁচ টাকা পাঠাতে হবে। সে কি? এ আবার কী কথা? কবিতা ছাপাতে টাকা দিতে হবে? আমরা পিছিয়ে গেলাম।

প্রশান্ত- সে সময় পাঁচ টাকার দামও ছিল অনেক। টাকাপয়সাও ছিল না।

উমা- টাকাটা বড় কথা কি আর? এ তো অসম্মানের। একজন নতুন কবিতা লেখকের কাছে বিরাট একটা ধাক্কা। 

অমিতাভ- ঠিক তাই। টাকা দিয়ে আমরা কবিতা ছাপাতে যাবো কেন? বেশ হতাশ হয়ে পড়লাম।

প্রশান্ত- এ তো চলেই। সেই একবার হলো না, কী একটা সংকলন, সংকলনে কবিতা রাখার জন্য টাকার দাবি। 

উমা- তা আর বলতে, নাম করা দু-এক জন সম্পাদককে এই সেদিনও দেখলাম ‘টাকা দিন কবিতা ছাপুন’ প্রকল্প করতে। এসব থাকবেই। আমাদের মুর্শিদাবাদেও এসব হয়। কিছু সম্পাদকের সংকলন মানেই টাকার খেল আর নিজের কবিতা ক’খানি সযত্নে গুঁজে দেওয়া। সে যাকগে।

অমিতাভ- তারপর কলেজে ঢুকলাম। কিছুদিনের মধ্যে তোমরা চলে এলে। হ্যাঁ সন্দীপ বিশ্বাস কে চিনতাম। ছাত্রনেতা সন্দীপ বিশ্বাস। আবৃত্তিও করত ভালো। কবিতা লিখত। 

প্রশান্ত- আরও ছিল। উৎপল গুপ্ত। সময় পত্রিকা। নারায়ণ ঘোষ আর তাপস ঘোষ তো আমাদের দুজনকে খুবই স্নেহ করতেন, কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। আর ছিলেন গোকুলেশ্বর ঘোষ। 

অমিতাভ- তুমি আর জমিল (সৈয়দ) এলে। 'শ্রাবস্তী' শুরু করেছ। ঢাউস পত্রিকা। তুমি, বুদ্ধিদীপ্ত চকচকে চোখ, আর উচ্ছ্বাস। আর জমিল, সাইলেন্ট, শান্ত, পুরো এক কবি। কী অসাধারণ কবিতা লিখছে সব। ভাবা যায়। ‘চন্দন বৃক্ষের নিচে পড়ে আছে লাল চুল … ’। এইসা বড় বড় সব পঙক্তি। মোহিত করে দেওয়া।

উমা- আমার খুব মনে আছে অমিতাভদা। আমি আর জমিল যেতাম। বসতাম তোমার বাইরের ঘরে। কত গল্প, আর পরিকল্পনা। প্রশান্তদার প্রেমের কথা বললে। আর তুমিও তো তখন প্রেমে মশগুল। সেই বালুরঘাট…

অমিতাভ- (হেসে) হ্যাঁ ঠিক ঠিক। বালুরঘাট…

উমা- গল্পের ফাঁক ফোকরে সেইসব কত প্রেমের চিঠি যে শুনেছি তোমার মুখে। আর তুমি কবিতাটাও লিখতে দারুন। আমার তো সব স্বপ্ন মনে হত। আমি তো তখন লিখতে পারতাম না, কিছুই হত না। কিন্তু তোমার প্রশান্তদার আর জমিলের কবিতা শুনলে মনে হত, এই তো এসবই তো আমি লিখতে চাই। তুমি বলছিলে জমিলের কথা। দেশ-এ তখনই ও কবিতা লিখে ফেলেছে। প্রথম কবিতাটার কথা মনে আছে। শেষ হচ্ছে আমেন আমেন উচ্চারণে।

অমিতাভ- ভাবা যায়! সেই সব পঙক্তি! ‘জলট্যাংকের পাশে ভিখারীনি হাসে…’। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে একটা ছেলে। জমিল যদি বাংলা কবিতায় থাকত…

উমা- হ্যাঁ, মানে কবিতা লেখা ছেড়ে না দিত, যেটা আমার ছেড়ে দেওয়ার কথা, তাহলে…

অমিতাভ- জমিল, আর সব ভাইদের তুলনায়…, এভাবে বলার কোনও মানে নেই যদিও, কিন্তু বাংলা কবিতাকে যে ও কোথায় নিয়ে যেত…

প্রশান্ত- দারুণ, দারুণ। আর ওর প্যাশন। কবিতাময় একদম।

উমা- হ্যাঁ, কলেজে ঢুকলাম, জমিল আমি একই, ঐ ফিজিক্স। আলাপ পরিচয় হৃদ্যতা হতে সময় লাগলো না। একসঙ্গেই চলি ঘুরিফিরি। কলেজে, বহরমপুর শহরে, ওর গ্রামের বাড়ি খোসবাসপুরে, আমার কাশিমবাজারের বাড়ি। আমাকে প্রচুর পড়ায়। আমিও কিছুকিছু। একদিন মেন হোস্টেলে বসে আড্ডা মারছি। খুব বৃষ্টি। আমি আবৃত্তি করছি, জীবনানন্দ, ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য…’। হঠাৎই জমিল বলে উঠল—উমা, একটা কবিতার কাগজ করলে হয়না? হ্যাঁ হয়। নাম হোক ‘শ্রাবস্তী’। এই শুরু হলো পত্রিকা করা। সবটা ক্রেডিটই ওর, আমি সঙ্গে থাকতাম। 

প্রশান্ত- আমাদের দুজনের হাঁটায় তখন বহরমপুর চিরে যাওয়া এন-এইচ-৩৪ বিখ্যাত হয়ে গেলো। দুজনে হাঁটতাম। কখনও হয়ত বা আরও দুজন থাকতো, আবার থাকতোও না। হেঁটে হেঁটে কতদূর চলে যাওয়া, আর কবিতার কথা। ওহো, সে গেছে একদিন। এই শহরটা আমার খুব গর্বের শহর। ৭৩ সাল পর্যন্ত খুব কাছ থেকে দেখেছি। পরেও গভীর যোগাযোগ ছিল বহুদিন। আর শ্রাবস্তীর কথা বলছিলে না, নামটা শুনে আমি যেটা তাৎক্ষণিক বলেছিলাম, সেটা আবার তোমরা পরের সংখ্যায় ছাপিয়েও দিয়েছিলে।

উমা- ঠিক তাই। তখন আমরা শ্যামলকান্তি দাশের একটা চিঠিও ছেপছিলাম।

অমিতাভ- হ্যাঁ হ্যাঁ, রাজেশ খান্নার বিয়ে টিয়ে নিয়ে। তোমরাতো একবার সম্পাদকীয়তে ছেপেছিলে—‘মাড়োয়ারির কবিতা ছাপতে হলেও, পত্রিকা চালাতে হবে’।

উমা- হ্যাঁ গো, টাকা পয়সা নেই। বড় অভিমান করে কথাটা আমিই বলেছিলাম, সেটা যে আবার জমিল লিখে ছেপে দেবে, ভাবতেই পারিনি। শ্রাবস্তীকে ঘিরে তোমাদের সঙ্গে যেমন, তেমনি আমার পরিচয় হয়ে গেলো উৎপল গুপ্ত, সন্দীপ বিশ্বাস, নারায়ণ ঘোষ, তাপস ঘোষ, পম্পু মজুমদার, আর রাজেন উপাধ্যায়, নিখিল কুমার সরকার, এঁদের সঙ্গে। রাজেনদা ছিলেন তখন বহরমপুরে বটবৃক্ষের মত অভিভাবক সুলভ কবি।

প্রশান্ত- শুধু তাই না, রাজেনদা ছিলেন রীতিভাঙার কবি। অসম্ভব প্যাশানেট।

অমিতাভ- তাঁর কবিতার ছিলো অদ্ভুত সুন্দর এক চলন। কবিতার বইএর নাম ছিলো ‘হাত ধরো মৈত্রেয়ী’। 

উমা- রাজেনদা, পম্পুদা এদের কাছে আমরা ছোটরা খুবই প্রশ্রয় আর আশ্রয় পেয়েছি। কবিতা নিয়ে এদের কাছে অনেক জেনেছি। পম্পুদা তো একসময় শিবাজী সংঘের ঘরে প্রতি রবিবার কবিতা পাঠ আর আলোচনার আসর বসাতো। সেখানে রাজেনদা এক অগ্রজ কবির ভূমিকা পালন করতেন। এরকমই এক আসরে আমার সমীরণের (ঘোষ) সঙ্গে প্রথম আলাপ। পম্পুদা চৌপর করত। একসময় তাতেও কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলাম।

অমিতাভ- পম্পু নাটক নিয়েও খুব মেতে থাকত। নাটক লিখত। একটা নাটকের নাম ছিলো ‘ধর্মগোলা’।

উমা- হ্যাঁ, ধর্মগোলা কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল, আর কলেজ ফেস্ট-এ মঞ্চস্থও হয়েছিলো। পরের দিকে তো পম্পুদা নাটক লেখায় ও করায় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলো।

প্রশান্ত- রাজেন দা মার্ভেলাস। যেমন কন্ঠস্বর তেমন কবিতা পড়ত। পরে শুনেছিলাম কোথায় চলে গেছেন। সন্ন্যাসী হয়ে গেছে্ন। বহরমপুরে কী সব গন্ডগোল… ওই আমাকে প্রথম তালের রসের তাড়ি খাইয়েছিল। সঙ্গে ছিল পম্পু। ও তো আমার শালা-ও বটে।

উমা- হ্যাঁ গো ওইরকম কবিতাঅন্ত মানুষটা কবিতা ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। একদম হারিয়ে গেল। পরে বছর কয়েক আগে আমি আর সমীরণ খোঁজ নিয়েছিলাম। কিছুদিন বহরমপুরে এসেছিলো। পরে তো মারাই গেছে। বড় মন কেমন হয়ে যায়। 

প্রশান্ত- হ্যাঁ, তুমি প্রদীপের সঙ্গে আড্ডার কথা বলছিলে। আমাদের দুজনের আড্ডা হতো ছাতে। প্রদীপের বাড়ির ছাতে বা আমার ঘরে। আমার ঘরটা ছিলো একটা চিলে-কোঠার মত। কিন্তু এত যে আমরা আড্ডা দিতাম, একসঙ্গে সময় কাটাতাম, আমাদের কবিতা কিন্তু ছিলো একদম ভিন্ন। একদম আলাদা। সে সময়ে 'মহারাজ' পত্রিকার সম্পাদক ফণীভূষণ আচার্য এটা মার্ক করেছিলেন। সুশীলদাও বলতেন। আর বলছিলে বহরমপুরের সে সময়ের সাহিত্য পরিমন্ডলের কথা। উৎপলদার ‘সময়’ তখন মধ্যগগনে। তাকে ঘিরে মণিষীমোহন রায়, সুশীল চট্টোপাধ্যায়, অরুণ ব্যানার্জী, সুশীল ভৌমিক আরও সব। পম্পুর চৌপর। তোমাদের শ্রাবস্তী। সেখানে এক ঝাঁক তরুণ। আদিনাথ মুখার্জীর ঐকতান বলে একটা কাগজ। এসব মিলিয়ে যেন একটা কবিতার জোয়ার, একটা বিস্ফোরণ। আরও কিছু পত্রিকা ছিল।

উমা- হ্যাঁ। দৌলতাবাদ থেকে নিখিলদা (নিখিল কুমার সরকার) করত 'ভীষ্ম' নামে পত্রিকা। বহরমপুর থেকে প্রদীপেন্দু দা (মৈত্র) করত 'কর্ণসুবর্ণ'। খড়গ্রাম থেকে এম মানোয়ার হোসাইন করত 'নৈবেদ্য' বলে একটা কবিতার কাগজ। হাসমত জালাল রা ‘উৎস’ নামে ছোট্ট কাগজ। তারপর নারায়ণদা তিমিরদার (মিত্র) কাগজ 'নরকের তাপ' কি তখনও প্রকাশ পেত?

প্রশান্ত- নরকের তাপ তো নয়। 'গান্ডীব'…

উমা- না না, গান্ডীব নারায়ণদার কবিতার বইএর নাম।

অমিতাভ- নরকের তাপ। তিমির মিত্র। আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। বহরমপুরে থাকত কিনা জানিনা। ক’দিন আগে অবশ্য পরিচয় হয়েছে। পরে নারায়ণদা বোধহয় 'গান্ধার' নামে পত্রিকা করতেন। খুব অন্যরকমের কাগজ।

উমা- হ্যাঁ, তিমিরদার সঙ্গে কদিন আগে আমারও পরিচয় হলো। এখন বহরমপুরেই থাকেন।

প্রশান্ত- ভীষ্ম কাগজে বাশার (আবুল বাশার) কবিতা লিখত। ওর প্রথম বইটার নাম যেন কী? জড় ও শিকড়ের ডালপালা, এমন হবে।

উমা- বাশারদার কবিতা আমি প্রথম পড়ি ওই ভীষ্মতেই। পরে তো গল্পে চলে গেলো।

প্রশান্ত- রবীন রায়চৌধুরীর একটা কাগজ ছিল কী যেন নাম…

অমিতাভ- ওই তো, সম্ভবত কবিতার জন্যে। আরেকটা কাগজ একটাই সংখ্যা বেরিয়েছিল। আমাদের মাষ্টারমশাই দীলিপ কর ছিলেন, তাঁর কাগজ, নাম 'দিগন্ত'। আমার আর প্রশান্তর কবিতা ছিল তাতে। আমি আর প্রশান্ত উৎপল দার কাছে যেতাম। উনি মাঝে মধ্যেই বলতেন, কবিতায় এই শব্দটা তোমার একটু অন্যরকম হলে… মানে এই শব্দটা… (হাসি) ওইরকমই।
প্রশান্ত- মানে খুঁতখুঁতেমি। একটু অর্থোডক্স প্রকৃতির।

উমা- আমি আর জমিল যেতাম। জমিলের তো আবার ডাইরেক্ট মাষ্টারমশাই ছিলেন। একদিন—‘জানো তো, এভরি থার্ড লাইন অফ এ পোয়েট্রি ইজ ডেঞ্জারাস’। আরেকদিন, ‘তোমার ওই অসমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহার কিন্তু খুব মারাত্মক’।

প্রশান্ত- আসলে বেরোতে চাইতেন না। কিন্তু এর কিছুদিন পর আত্মপ্রকাশ করে 'রৌরব'। শুভ (চট্টোপাধ্যায়), শান্তিময় (মুখোপাধ্যায়), অচিন্ত্য বসু…

উমা- সমীরণ (ঘোষ)।

প্রশান্ত- হ্যাঁ, সমীরণ। রবীন বিশ্বাস। এরা সব নতু্নভাবে কবিতাকে সামনে নিয়ে আসে। মানে ওই খুঁতখুতেমি, সীমাবদ্ধতা এসব এড়িয়ে গিয়ে। সব মিলিয়ে একটা উৎসাহব্যঞ্জক পরিবেশ। একটা সুসসময়। তুমি বলছিলে না, তোমাদের সামনে আমরা ছিলাম, তেমনি আমাদের সামনে ছিলেন, সুশীল ভৌমিক, মণিষীমোহন রায়, গোকুলেশ্বর ঘোষ, উৎপল গুপ্ত… এঁরা।

উমা- তারপর নারায়ণ দা, তাপস দা এরা।

প্রশান্ত- ঠিক। এরা দুজন তো আমাদের খুব কাছের ছিলেন।

উমা- এছাড়া আরেকজন কবি ছিলেন, আমার মাষ্টারমশাই, বিমল চক্রবর্তী, থাকতেন আমাদের বাড়ির কাছে মণীন্দ্রনগরে। সাহিত্যিক অতীন বন্দোপাধ্যায়ের বন্ধু। দেশ-এ কবিতা লিখতেন। উনি আমাকে কবিতা লেখার ব্যাপারে জড়াতে চাইতেন। কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। সাহিত্যচর্চা বলে একটা আড্ডা বা আসর বসাতেন। পত্রিকা করতেন 'উত্তরকাল' নামে।

অমিতাভ- ঠিকই। আমাদের সঙ্গে তেমন আলাপ পরিচয় ছিল না। কবিতা পড়েছি। 

উমা- আচ্ছা অমিতাভদা। তখন বহরমপুর থেকে কবি সাহিত্যিক মণীষ ঘটকের 'বর্তিকা' পত্রিকাটা বেরোতো। তো তোমাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ছিল?

অমিতাভ- ওরে বাবা! না না। তেমন কিছু না। বিশাল ব্যক্তিত্ব। ওই দূর থেকে দু-একবার দেখেছি। রিক্সা করে চলে যেতেন। উনার স্ত্রী কোথাও বলেছিলেন, বা কথিত আছে উনি ল্যাম্পপোস্ট থেকে সিগারেট ধরাতেন। মানে, গ্যাসের আলোয়…। উনি তো এক বিশাল মাপের মানুষ, আমরা ছিলাম বামন…।

উমা- ঠিক তাই। আমার তো সাহসই হয়নি কাছে ঘেঁষার। সুযোগ ছিল, পম্পুদার যাতায়াত ছিল, বলেওছিল, আমাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু ভয়ে যাইনি। একবার হলো কি, গ্রান্টহলে একটা আবৃত্তি আর ডিবেট কম্পিটিশন ছিল। আমি ছিলাম একজন প্রতিযোগী। অনুষ্ঠান শেষ হতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যাচ্ছিল। মণীষ ঘটক ছিলেন সেই ক্লাবের মেম্বার। দেরি হওয়ায় ওঁদের তাস খেলার বিঘ্ন ঘটছিল। উনি তখন হলে ঢুকে প্রায় হুঙ্কারের সুরে বলে উঠলেন—এসব এখনও কী হচ্ছে? অনুষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা দেখলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই সব গুটিয়ে নিলেন। ওই দীর্ঘ মানুষটির অমন সৌম্যকান্তি চেহারা, তেমন বাজখাই গলা। ভাবা যায় না। শুনেছিলাম, তাস খেলার ভীষণ নেশা, জুয়াটুয়াও নাকি চলত। আরেকটা কাগজ ছিল স্যারের। দীপঙ্কর চক্রবর্তীর। অনীক।

প্রশান্ত- হ্যাঁ ওটা ছিল একদম অন্য ধরণের কাগজ। রাজনীতি, সমাজনীতি এইসব নিয়ে। কবিতাও ছাপত, তবে বিশেষ ধরণের। আর মণীষ ঘটককে আমি একবার প্রণাম করেছিলাম। পম্পুই নিয়ে গিয়েছিল। তো দূরত্ব রেখে সশ্রদ্ধ প্রণাম করলাম। ভাবলাম, এই তাহলে যুবনাশ্ব! আর উনি সন্ধ্যায় যেতেন 'শ্রদ্ধাঞ্জলী' চা দোকানের ওখানে আড্ডা দিতে। বাবার কথামত আমি শ্রদ্ধাঞ্জলী থেকে চা-পাতা আনতাম। তখনও দেখেছি কয়েকবার। 

অমিতাভ- আরও কিছু পরে, মানে এখন থেকে বছর তিরিশেক হবে, আরেকটা ঘটনা মনে আছে… মণীষ ঘটক মারা গেছেন। গ্রান্টহলে তাঁর স্মরণসভা। তা আমার মাষ্টারমশাই ছিলেন ফল্গু ঘটক, কলিজিয়েট স্কুলে পড়াতেন, মণীষ ঘটকের ছেলে। তিনি মঞ্চে উঠে এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন, একদম জ্বালাময়ী… আপনারা সব নপুংশক… ক্লীব… সাহিত্য করতে এসছেন… খুব যে একটা মদ খেয়ে টালমাটাল ছিলেন, তা মনে হয়নি, কিন্তু ঐ ভাষণ… হল একদম চুপ। 

উমা- ভাবা যায়! আমি ছিলাম না। সে সময় বহরমপুর থাকতাম না। পরে অবশ্য ওঁর শতবার্ষিকী স্মরণসভায় ছিলাম। কমিটিতেও ছিলাম। রবীন্দ্রসদনে। একটা স্মরণিকাও প্রকাশ পেয়েছিল। আচ্ছা অমিতাভদা প্রশান্তদা, আমরা যখন কলেজে ঢুকি তোমরা তখন কলেজ ছাড়ব ছাড়ব করছ। আচ্ছা সেই সময় যে নকশাল আন্দোলন, সঙ্গে হত্যার রাজনীতি, তৈরি হচ্ছে কংশাল বলে এক অপরিচিত অদৃশ্য শক্তি, আলোড়ন চলছে বহরমপুর জুড়ে, সঙ্গে ফিসফাস, একটা ভয়, আতঙ্ক। এর প্রভাব তোমাদের ওপর কেমন পড়েছিল?

অমিতাভ- হুঁ। একটা অস্থির অবস্থা। কোনও যোগাযোগ ছিল না। জানতাম, অরূপ চন্দ্র এসবের সঙ্গে কিছুটা জড়িয়ে ছিল। ওই পর্যন্তই।

উমা- একবার, কলেজে পড়তে পড়তেই পাশের সেন্ট্রাল জেলে পাগলাঘণ্টা বেজেছিল। আমরা সব দৌড়ে ফিজিক্স থিয়েটারের ছাতের ওপর উঠে নজর করলাম। কিছুই দেখতে পেলাম না অবশ্য। 

প্রশান্ত- হ্যাঁ, মনে আছে। আমরা তখন বীরেনের দোকানে বসে ছিলাম। ওখানে আমরা একটা স্পেশাল খাবার খেতাম। পাউরুটি ভাজা চানাচুর দিয়ে। সেইসব খেতে খেতে এক দুপুরে শুনেছিলাম সাইরেন। প্রবল এবং দীর্ঘ। পরদিন তো কারফু আরও কত কী। শুনেছিলাম জেল থেকে অনেক লাশ পাচার করা হয়েছিল।

উমা- আর হত্যা। একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের দিনে বা রাতে হত্যা তখন বহরমপুরে আকছাড় ঘটতে লাগল। কণক বাবু, সন্তোষ ভট্টাচার্য…। খুন যেন জলভাত। আর পুলিশের অত্যাচার।

অমিতাভ- আসলে, নকশাল আন্দোলনে তত্ত্বটা ঠিক আছে, কিন্তু প্রয়োগ বড় গন্ডগোলের, বিভীষিকাময়। এসব ঠিক ভালো লাগত না, এটা মনে আছে। অনেক কিছুই ঠিকঠাক হয়নি।

প্রশান্ত- এই তত্ত্ব আর তার প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক ছিল, এখনো আছে, আরও থাকবে হয়ত। কিন্তু একটা কথা তো ঠিক, যে ধনের অসম বন্টন ব্যাবস্থার জন্যই এতসব। আর অসাম্য ছিল, খুব বেশি মাত্রায় ছিল। এটা তো ঠিক, সেই সময় আমাদেরও ভাবতে হত যে, আমরা চির বেকার আর ব্যাচেলার থাকব। চাকরি হবে না আমাদের কোনওদিন, বিয়ে থাওয়ায় হবে না। শুধু এক শ্রেণীর মানুষের জন্যই সবকিছু। তাতে যুবক তরুণের ওপর প্রভাব পড়বেই। আর সেটা রাজনীতি ক্যাপচার করে নিলে, এসব ঘটতে থাকবে।

উমা- এই নকশাল আন্দোলন আর হত্যার রাজনীতি নিয়ে কিন্তু আমার বেশ কয়েকটা হ্যাপা পোয়াতে হয়েছে। আবার দুর্বলতাও তৈরি হয়েছিল। আমাকে খুব হন্ট করেছিল।

প্রশান্ত- কী রকম!

উমা- আমি তো শহরের লাগোয়া গ্রামে থাকতাম। কাশিমবাজার, মণীন্দ্রনগর। এতসব বুঝতাম না, খবরও পেতাম না। আঁচ করতাম, একটা কিছু ঘটছে। হত্যার খবরগুলো একটু বাসি হয়ে আসত। তো হায়ার সেকেণ্ডারি পড়ি, একদিন, স্কুলের দেয়ালে আলকাতরা দিয়ে আঁকাবাঁকা অক্ষরে দেখলাম লেখা আছে, চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। সেই স্কুলে বাবাই তখন হেডমাষ্টার। বাড়িতে কিছু বললেন না বা দেয়াল পরিষ্কার করাতেও দেখলাম না। বাবা তো ঠিক এই চরিত্রের মানুষ নন। একটা ধন্দ লেগেছিল। তারপর পরীক্ষার পর, ৭১ সাল, জামাইবাবুর সঙ্গে মোগলসরাই বেড়াতে যাওয়ার পথে আরেক জামাইবাবুর কলকাতার মানিকতলার বাড়িতে রাতে থাকতে হবে। পরদিন ট্রেন। আমার প্রথম কলকাতা, জামাইবাবুও প্রবাসী। তেমন কিছু জানেন না। বিকেলের দিকে আমরা দুজনে একটু ঘুরতে বেরোলাম। বৃষ্টি এলো। তো আমরা সিটি কলেজ বা বিদ্যাসাগর কলেজের মধ্যে ঢুকে আশ্রয় নিলাম। অনেক তরুণ যুবক ছাত্র। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু-তিনজন ছেলে এসে আমার বুকের কাছে জামাটা খামচি মেরে ধরে একটু আড়ালের দিকে নিয়ে গেল। ছেলেগুলো একটু ষণ্ডা মত। আমিতো ভয়ে জড়সড়ো। --আ বে, তোর নাম কি রে? কী করিস? কোথায় থাকা হয়? আমি- কাশিমবাজার।-- আরে কাশিপুরের মাল এখানে চলে এসেছে রে। মনে হচ্ছে স্পাই পাঠিয়েছে। আমি- না না, কাশিপুর নয়, কাশিমবাজার। -- সে পোঙায় পাইপগান ঠেকালেই বোঝা যাবে কাশিপুর না কাশিমবাজার, আর ধান্দাটা কী! আরও দু-একজন চলে এল। আমি প্রমাদ গুনে কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, দেখি জামাইবাবু এসে দাঁড়িয়েছে। তখন জামাইবাবুর সঙ্গে একপ্রস্থ কথাবার্তা বলে ওরা আমাকে ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমরা ঘরমুখো। আমার ছেলেগুলোর আচরণে আর কথায় খুব রাগ হয়েছিল। রাতে বড় জামাইবাবুর মুখে শুনলাম, এসবই হচ্ছে এখন কলেজে কলেজে, পাড়ায় পাড়ায়। এলাকা দখল, আর দখলে রাখা। একটু এদিক থেকে ওদিকে হলেই, গুমখুন, আমার লাশও নাকি পাওয়া যেত না।

প্রশান্ত- বাবা! এতো ভয়ংকর ব্যাপার। এখানে আমরা এতটা বুঝিনি। তবে টেক্সটাইল কলেজ ছিল ডেন, শুনেছি। আমাদের কলেজেও কিছু ছিল, চুপেচাপে।

উমা- কিছুদিন পর, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। ৭২ সাল। একদিন পাড়ায় শুনলাম আমার দাদার এক বন্ধু, নাম পন্থু, নকশাল হয়ে গিয়েছিল, কলকাতায় পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা গেছে। পরে আরও জানা গেল, পন্থু পাড়ারই আরও কয়েকজনকে জুটিয়ে নিয়েছিল। স্কুলের দেয়ালে ঐসব লেখা ওরই কাজ। আর যারা ছিল, তার মধ্যে আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধুও ছিল। এই মৃত্যুটা কিন্তু আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। মা বাবার একমাত্র সন্তান, স্বচ্ছল, লেখাপড়াতেও ভালো, আর আমাদের খুব কাছের মানুষ। পন্থুর মৃত্যুতে কষ্টের চেয়েও রাগ হয়েছিল বেশি। সেটা ছিল আগের রাগের বিরুদ্ধ দিকে।

অমিতাভ- আমাদেরও দু-একজন বন্ধুর কিছুটা যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ওই যে বল্লাম, তত্ত্ব আর প্রয়োগ, আর শেষে তো তত্ত্ব ফত্ত্বও কিছু ছিল না। গো এজ উই লাইক, যে যার মত…

উমা- আরেকটা ঘটনা, আমাকে আজও তাড়া করে। আমি খাগড়ার রূপালি সঙ্ঘে ভলিবল খেলতাম। ক্লাবটা ভলিতে জেলা কেন জেলার বাইরেও সুনাম করেছিল। সকালে সাইকেলে কাশিমবাজারের বাড়ি থেকে গোরাবাজারে কলেজ, কলেজ শেষে সাইকেলে খাগড়ার জি,টি,আই স্কুলের মাঠ। ওটাই রূপালি সঙ্ঘের ভলিবলের মাঠ। খেলা শেষে সাইকেলে সন্ধ্যায় বাড়ি। এই ছিল রুটিন। তো চলছিল ভালোই। কিন্তু খাগড়া অঞ্চলে উত্তেজনা ছিল বেশি। ৭৩-৭৪ হবে। এক সন্ধ্যায়, শীতের, খেলা শেষে জগদম্বার গলিতে বসে চা-বিস্কুট এসব খাচ্ছি, প্রমোদ-দা, যিনি আমাদের খেলা শেখাতেন, উনিই প্রতিদিন কিছু না কিছু…, অন্ধকার হয়ে এসেছে, হঠাৎই মেন রাস্তার ধাপিতে বসে থেকে আমাদের চোখ ঝলসে উঠল গলিতে, ছুরিকাঘাত। মুহুর্তে দেখলাম ছুরি উঠল একজনের হাতে, ছুরি নেমে এল আরেকজনের শরীরের কোথাও। ব্যাস্, মুহুর্তে প্রমোদ দা আমাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে পালিয়ে যেতে বলল। আমরাও তাই। রাতে বাড়িতে ভালো করে ভাত খেতে পারলাম না, ক্ষিধে থাকা সত্তেও। আসলে আমি ছিলাম দুর্বল প্রকৃতির। এই ঘটনা, আন্দোলনের প্রতি আমার দুর্বলতাকে অনেকাংশে মিলিয়ে দিল। আমি তো ঝুঁকছিলাম…। পরে লেখাতেও এসেছে…

প্রশান্ত- আমারও এমনই খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কয়েকদিন। যখন এক জৈন পরিবারের এক ছেলেকে কল্পনা হাউসের গলিতে হুইলার হোস্টেলের সামনে হত্যা করা হল। দেবেন ছিল আমাদের পরিবারের খুব কাছের মানুষ। ও ছিল পম্পুর খুব বন্ধু। মনে হয়েছিল, ঘটনাটা যেন আমাদের বাড়ির কাছেই হয়ে গেল। তো, সত্যি এগুলো আমাদের ওপর একধরনের প্রভাব রেখেছে বৈকি।

উমা- আর পুলিশের অত্যাচার! দীপক ব্যানার্জী, আমার বন্ধু। থাকত সৈদাবাদ পুলিশ ফাঁড়ির কাছে। সেটা আমাদের ফাইন্যাল ইয়ার। সামনে পরীক্ষা। ৭৪ সাল। এক রাতে ওই ফাঁড়ি থেকে সাতটা রাইফেল ছিনতাই। দুজন কনস্টেবল মুন্ডুহীন…  

প্রশান্ত- ঠিক ঠিক। খুব মনে আছে। মুন্ডুহীন দেহ নাকি লাইটপোস্টে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তোলপাড় শহর…। ধরপাকড়…। ওই সময় এক টাউন দারোগা ছিল, কী যেন নামটা, দোর্দন্ড প্রতাপ তার, ভয়ংকর লোক। নকশালরা ওকে টার্গেট করেছিল। কিন্তু পারেনি…। একটা টানাপোড়েন। একদিকে মনে হচ্ছে এই পুরো সিস্টেমটা বদলানো দরকার… এটা সত্যি শুয়োরের খোঁয়াড়, অন্যদিকে এই ব্যাক্তিহত্যা…।

উমা- দীপকদের পাড়ার সব ইয়ং ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে থানায় অকথ্য অত্যাচার। উলটো করে ঝুলিয়ে ব্যাটনের মার। দীপক কোনওমতে পালিয়ে আমাদের বাড়ি। কদিন থেকে পরীক্ষা দেওয়াটা শুরু করেছিল। ওর মুখে বর্ণনা শুনে শীতল আমি। ভক্তি ছুটে যাওয়ার উপক্রম…। তো এইভাবে জীবনে জড়িয়ে যাচ্ছিল, প্রভাব পড়ছিল… ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচকের দিকেই বেশি।

অমিতাভ- একটা দূরত্ব তৈরি করে ফেলছিল…। বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়ছিল… 

উমা- আরেকটা বিষয় অমিতাভদা। সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশ গঠন, মুক্তিযুদ্ধ। ৭১। মুর্শিদাবাদ একদম সীমান্তবর্তী জেলা। ওটার প্রভাব কেমন পড়েছিল জনজীবনে, মনে, লেখাপত্রে…

অমিতাভ- হুঁ। সেও এক উন্মাদনা। রাতবিরেতে হুস করে যুদ্ধবিমান উড়ে যেতো পূর্ব পাকিস্থানের দিকে। ফিরেও আসত। কাছেই বাঞ্জেটিয়ায় সেনা ছাউনি। রাস্তাঘাটে মিলিটারির ভারি ট্রাকের শব্দ। রেডিওতে যুদ্ধের তাজা খবর, যে অস্থায়ী স্টেশনটা, সেটা নাকি মুর্শিদাবাদেরই কোনও এক অঞ্চলে। লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা… খেয়াল করেছি… মনেও আছে… প্রত্যক্ষ প্রভাব হয়ত সেভাবে নাড়ায়নি। কলেজ লাইফ… তবে  মারাত্মক কিছু যে ঘটছে, যুদ্ধ যে হচ্ছে, তাতো বুঝতেই পারতাম।

উমা- হ্যাঁ, আমার বাড়ি এম-আই-টির খুব কাছে ছিল তো। ওদিকে যেতেই দিত না। কলেজ বন্ধ, হস্টেল বন্ধ করে ছাত্ররা বাড়িতে। কী যে হত ওখানে। তবে কলেজ যাতায়াতে ওদের প্রবল উপস্থিতি টের পেতাম। তুমি যে বল্লে না বিমানের কথা, ওগুলো কলাইকুন্ডা থেকে উড়ে গিয়ে বোম্বিং করে আসত। ফলশ্রুতিতে রিলিফ ক্যাম্প, কাছাকাছি নিমতলা হাতীনগর লালবাগ সব জায়গায়, কী চাপ, জিনিসপত্রের দাম বাড়তে লাগল। উন্মাদনা। বন্ধুরা মিলে রাস্তায় রাস্তায় স্কোয়াডিং করে মালপত্র জামাকাপড় টাকাপয়সা সংগ্রহ। পড়াশুনা একটু শিকেয় প্রায়… সংগৃহীত টাকাপয়সা মালপত্র নেতাদের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা। সে আদৌ পৌঁছেছে কিনা আজও জানিনা। ভাবনাচিন্তা পরিকল্পনা করে কোনও কিছু করা নয়ত। করার কথাও নয় তখন। একটা ঘোর আর আবেগ। উন্মাদনার একটা প্রবাহ, আর সেই প্রবাহে সরব উপস্থিতি রাখার আপ্রাণ। রিলিফ ক্যাম্প সম্পর্কিত কাজে এক দাদা ও এক দিদির চাকরি। নরকের চেয়ে একটু ভালো রাখার চেষ্টায় ক্যাম্পের নানা গল্প ওদের মুখে। বিদেশী সামগ্রী, তাও চোরা মার্কেটে… অপচয়… কিছু মানুষের বড়লোক বনে যাওয়া… সবই চোখের সামনে… রাজনীতি… এশিয়ার মুক্তিসূর্য… নতুন দেশ, বাংলাদেশ। সপ্তম নৌবহর, রাশিয়ার ভেটো… আরও কত কী সব। সব মিলিয়ে আঠারো ছুঁয়ে থাকার সব রসদ।

প্রশান্ত- যুদ্ধটা আমার অতোটা মনে নেই। কিন্তু দুটো জিনিস খুব নাড়া দিয়েছিল। এক – একবার লালগোলার কাছে কলকলি তে এক বন্ধুর সঙ্গে একটা রিলিফ-ক্যাম্পে যাই। এক ভয়ংকর নরক দর্শন হয়েছিল আমার। মানুষ… আহা মানুষ…। সত্যিকারের নরক। দুই – আমাদের রাজশাহীর কাছে গোদাগাড়ি তে আমাদেরই পরিবারের খুব কাছের এক পরিবার, তার কর্তা ছিল জজকোর্টের নাইটগার্ড, খবর পাওয়া গেল রাজাকাররা তাকে মেরে ফেলেছে। তার ছেলে আফসার মানে মঙ্গলকে কেউ এপারে নিয়ে আসে। সদ্য কিশোর, কোথায় আর থাকবে! আমাদের বাড়িতেই তার ঠাঁই হয়। আমারই বয়সী প্রায়। সে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমাদের রানীবাগানের বাড়িতে আমার সঙ্গেই ছিল। ওকে দেখে খুব খারাপ লেগেছিল। পরে অবশ্য জানা যায়, সৌভাগ্যবশত উনি পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, মারা যাননি। এক কষ্টকর সময় এটা।

অমিতাভ- হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে এই দশকে কবিতা… একটা দারুণ… যা সব কবিতা পড়তাম। সাংঘাতিক সব। আবেগ, টানাপোড়েন, স্বপ্ন, একটা অন্য উচ্চতায় চলে যায়।

প্রশান্ত- হ্যাঁ, সুনীল গাঙ্গুলী তখন লিখছেন চে গুয়েভারার মৃত্যু।

উমা- চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়…

অমিতাভ- হ্যাঁ, তখন একটা আবেগ কাজ করেছিল ঠিকই, ভালোও লাগত…। কিন্তু পরবর্তীকালে কিন্তু আমার মনে হয়েছে, ভদ্রলোক একদম শিখে, লেখাপড়া শিখে, শিল্পসম্মতভাবে কবিতাটা লিখেছেন। জীবনের সঙ্গে এর কোনও নাড়ীর টান, নিবিড় কোনও যোগ আর খুঁজে পাই না।

উমা- অমিতাভদা। এটাও তো ঠিক, স্বপ্নভঙ্গও এই একই দশকে। গড়ে ওঠা স্বপ্ন তো স্বপ্নভঙ্গেই সামিল হয়ে গেল। নকশাল আন্দোলন, স্বপ্ন গড়ে ওঠা, মুক্তিযুদ্ধ, স্বপ্ন গড়ে ওঠা, সবই কিন্তু একটা কেমন অস্থিরতার মধ্যে ভেঙে ভেঙে টুকরো হতে থাকল এই দশকেই…। কবিতায় অবশ্য তুমি যেটা বললে তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ল খুব।

প্রশান্ত- একদম। কিন্তু সেই সময়ে উমা, আমাদের এই মুর্শিদাবাদে বহরমপুরে এই যে দুটো ঘটনা, তার আলোড়ন, এপার্ট ফ্রম বাংলাদেশ ওয়ার, এই রাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে কিন্তু আমরা যাদের কথা বললাম তারা একটি কথাও বলেননি, লিখেনও নি, পক্ষে বা বিপক্ষে। একদম চুপ।

উমা- জরুরি অবস্থাই ধরো না। তারও তো প্রত্যক্ষ প্রভাব সমাজে পড়েছে। সেখানেও তো কম অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি কিছু মানুষকে। কিন্তু আমার মনে পড়ে না, লেখক কলা-কুশলীরা বহরমপুরে তেমন কিছু একটা করেছে। করলেও ভেতরে ভেতরে। আমরা সেভাবে টের পাইনি। তোমরা বোধহয় তখন সরকারি চাকরি নিয়ে বহরমপুরের বাইরে। আমার রেজাল্ট আউট হবে হবে। কিন্তু বাড়ির অনুশাসন খুব বেড়ে গিয়েছিল। আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছিলাম, বামপন্থী রাজনীতি করা মানুষদের ওপর একটা এক্সট্রা চাপ। বিশেষত কলেজের প্রফেসর, স্কুলের শিক্ষক, এঁদের ওপর।

প্রশান্ত- আরে সেও তো রাজনীতিই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

অমিতাভ- পালাবদল ঘটে গেল একদম। রাজনৈতিক পালাবদল।   

উমা- সেটা একদম ঠিক কথা। যাক সে…। আচ্ছা সেই সময়ে বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদে গল্প উপন্যাস গদ্য কারা লিখতেন, মনে আছে?

অমিতাভ- মণীষ ঘটক বাদ দিলে… ওই সময় তিনি কি আদৌ আর কিছু লিখতেন কিনা আমার জানা নেই, গল্প লিখতেন দিব্যেশ লাহিড়ী, প্রণব বন্দোপাধ্যায়…

উমা- দিব্যেশ দা তো নাটকও লিখতেন। উনি অনেক মঞ্চ সফল নাটকের প্রণেতা। ‘না না হে’, ‘দরজায় করাঘাত’, ‘গণ্ডার’, এসব তাঁর নামকরা নাটক, যা 'প্রান্তিক' মঞ্চস্থ করেছিল।

অমিতাভ- এছাড়া রবীন রায়চৌধুরী, ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়…

উমা- গুণময় মান্না কিন্তু বহরমপুরেই থাকতেন, অধ্যাপনা করতেন, আর দারুণ সব গল্প উপন্যাস লিখে গেছেন।

প্রশান্ত- হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটু পরের দিকে বাশার, মানে আবুল বাশার…

উমা- হ্যাঁ, তারও কিছু পরে শুভ (চট্টোপাধ্যায়)। সাতের দশকের গোড়ার দিকে বিমল চক্রবর্তী রবীন রায়চৌধুরীরা মিলে একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। নাম ছিল ‘উত্তর জাহ্নবী’।

প্রশান্ত- হ্যাঁ কবিতা, নানা ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকা, নাটক, গল্প-উপন্যাস সব মিলিয়ে বহরমপুর তখন একদম উত্তাল, ভরপুর। কী উন্মাদনা…

অমিতাভ- বিমল চক্রবর্তী বললে… গল্প তেমন পড়িনি, কবিতাই পড়েছি, তো উনার একটা নিবন্ধ পড়েছিলাম 'এষণা' পত্রিকায়। তাতে তিনি লিখেছিলেন গদ্যে কাফকা আর কবিতায় পাস্তেরনাক তাঁকে খুব ভাবায় এবং এঁরা বিশ্বসাহিত্যের মাইলস্টোন। তা আমি ভাবলাম, এত পড়ে এসে, সব গুলে খেয়ে শেষে পাস্তেরনাক, আর কেউ নেই? পাস্তেরনাক কী এমন ভাঙচুরই বা করেছিলেন?

উমা- কিন্তু, অমিতাভদা, কাফকা বলেছেন, গল্পে উনি তো ভীষণ ভাঙচুর…

অমিতাভ- না না, উনি কাফকার কথা বলেন নি। আমার বলতে ভুল হয়েছে। পাস্তেরনাক…। ঠিকই আছে। উনি উনার মত বলেছেন। আমি শুধু ভাবছিলাম, শুধুই দুটো নাম…আর কেউ নেই…আর কেউ কিছু করেনি… এইসব।

প্রশান্ত- মজা হচ্ছে, আমার আর প্রদীপের, এই বহরমপুরে একমাত্র সুশীল ভৌমিকের কথাবার্তা ছাড়া আর তেমন কারো কথা খুব উল্লেখযোগ্য কিছু মনে হত না।

অমিতাভ- হ্যাঁ, এটা ঠিক। সুশীলদা একদম আলাদা…। আমাদের অন্য কাউকে তেমন কিছু লাগেনি…

উমা- শুধু তোমরা কেন প্রশান্ত দা। আমরা বিশেষত আমি ওঁর কম সাহচর্য আর আশীর্বাদ পাইনি! শ্রাবস্তী পর্বে পরিচয়টুকুই ছিল, তেমন হৃদ্যতা কিছু ছিল না, বুঝতামই বা কী! কিন্তু ৮২ তে বহরমপুর ফিরে এলে উনিই আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্রয় আশ্রয় দিয়েছেন। ৭৯-৮২, কলকাতার কয়েকটা পত্রিকায় আমার কবিতা পড়ে উনি আমাকে বলতেন ‘তুমি একটু অন্যরকম, এটাই চাই’। রৌরবে যুক্ত হওয়ার বেশ কিছুটা পরে দেখলাম যে কোনও কারণেই হোক, ওদের সঙ্গে সুশীলদার একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তো আমিই উদ্যোগ নিয়ে সেই দূরত্ব কমাই। একদম অন্যধারার কবি। ষাটের এত আলোড়ন, আন্দোলন, উনি কোনওটাতেই যুক্ত না হয়ে একাই একদম প্রথার বাইরে গিয়ে লিখেছেন।

অমিতাভ- বহরমপুর কিন্তু সুশীলদাকে তেমন পাত্তা দেয়নি। বলা হত, পাগল… কী সব লেখে…। এই আমরা কয়েকজন তরুণ পেছনে থাকতাম। খুব খুঁতখুঁতে। লিখতেন আর জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। সেসব যোগাড় করে পত্রিকায় পাচার করতাম। তোমাদের 'শ্রাবস্তী'তেও পাচার করেছি। আমাদের তো তখন কোনও পত্রিকা ছিল না। সুশীলদার সঙ্গে আমাদের পরিচয়টাও বেশ মনে আছে। তখন কবিরুল ইসলাম এসেছেন বহরমপুরে। আরও কেউ কেউ। উৎপলদাও আছেন। বীরেনের চায়ের দোকানের সামনে আমরা। তো উনিই এগিয়ে এলেন, ও তুমি অমিতাভ? তুমি প্রশান্ত?  তোমরা সব কবিতা লেখ বুঝি? বেশ, বেশ। তখন থাকতেন সারগাছিতে। একবার আমি প্রশান্ত আর জমিল গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে। উনি নেই… ঘর খোলা… একটা তক্তপোষ ছাড়া কিচ্ছু নেই। আর বই…। দেয়ালে, সবুজ রঙের দরজার ওপরে পেন্সিলে যথেচ্ছ লেখা… আমরা কিছুক্ষণ থেকে আসব… তখন উনি এলেন…

প্রশান্ত- সন্ন্যাসী যাকে বলে। আর পড়া মানে! বিদেশী সাহিত্যকে একদম গুলে খেয়েছেন। কথাও বলতেন খুব বুদ্ধিদীপ্ত আর মজার। আমাদের একটু অন্যরকম লেখালিখির তিনিই ছিলেন মূল আকর্ষণ। আর দ্যাখো, উনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন প্রশ্রয় দিতেন কে? না সঞ্জয় ভট্টাচার্য। পূর্বাশাই উনাকে সবচেয়ে বেশি প্রকাশ করেছে। আর পি, আচার্য। মানে ফণীভূষণ আচার্য। মহারাজ পত্রিকা। আরেকজন এডমায়ারার ছিলেন। তিনি প্রদীপেন্দু মৈত্র। হয়ত বা এভাবে বললে অতিশোয়ক্তি মনে হবে তবু সত্যি যা, তা হল—উনি অন্ধকারের জগতে আলো দেখাতেন। আমরা হয়তবা সেসময়ে সবটা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু উনি দেখাতেন। অনবদ্য। অন্যরকম ভাবনা…

উমা- এটা ঠিক। আমরা অনেকেই ছিলাম তাঁর গুণগ্রাহী। তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণাস্থল। ৮৮ থেকে ৯৫ আমি ছিলাম বহরমপুরের বাইরে। এই ৯৫ এর পর তিনি আমাকে বাছাই করা অনেক পত্রিকায় কবিতা পাঠাতে বলতেন। নিজে পাঠাতেন না। উনিই একসময় একদম প্রায় জোর করেই আমার কবিতা কৌরব-এ পাঠিয়েছিলেন। সেই সূত্রে কবি বারীন ঘোষালের সঙ্গে আমার চিঠিতে পরিচয়। পরে উনার বাড়িতেই বারীনদার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়। এরকম আরও আছে। কিন্তু খুব আত্মপ্রচার বিমুখ নির্জনতার কবি উনি। এগিয়ে থাকা মানুষ আর কবি। তাই লোকে পাগল ভাবত। তবে এটা ঠিক খুব এলোমেলো ছিলেন তিনি।

অমিতাভ- আবার একটু একগুঁয়েও ছিলেন। আমি তখন খুব ভাস্কর চক্রবর্তী পড়ছি। আমি তো খুব ভক্ত। তা দেখেশুনে একদিন বললেন— এসব কী পড়ছ? কী আছে এতে? একই রকম। কিচ্ছু নেই এতে, শুধু প্যানপ্যানানি, রোম্যান্স, আর ব্যক্তিক বিষাদ। কী হবে পড়ে? আমার তো ভালো লাগে… এখনও লাগে…। একবার জমিল শ্রাবস্তীতে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার লাইন কোট করে কিছু লিখেছিল, হলুদ রঙের মলাট, সেই সংখ্যায়, তা দেখে সুশীলদা প্রায় রেগে—এসব কিছু থাকবে না। একটা অসুস্থ মানুষের একই কথা ঘুরেফিরে…

উমা- হ্যাঁ সুশীল দা রোম্যান্স থেকে কবিতাকে মুক্ত করতে চাইতেন। রোম্যান্স তছনছ করতে চাইতেন। বলতেনও। আর বিষাদের বদলে পুড়তে চাইতেন। মনে হয় মিথটাকে ভাঙতে চাইতেন। আমারও ভাস্কর চক্রবর্তীর বেশ কিছু ভালো লাগে… তা নিয়ে প্রশ্নের মুখেও পড়ি… কিন্তু লাগে। এই তো কদিন আগেই ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’ থেকে একটা কবিতা নিয়ে একটা গদ্যও লিখলাম। 

অমিতাভ- একটা কথা বলা হয় না, -- এই উমাপদ তুমি খুব আটকে গেছো, বেরোতে পারছ না। এই অমিতাভ বা প্রশান্ত—তোমরা একই রকম, একই জায়গায়, বেরোতে পারছ না, ইত্যাদি। তো ভাস্কর চক্রবর্তী তো সারা জীবনে একই ভাব-ভাবনা আর ভাষারীতি দিয়ে বেশ চালিয়ে গেলেন। ওইসব চেঞ্জ ফেঞ্জের কোনো ব্যাপার নেই।

প্রশান্ত- আরে শুধু ভাস্কর কেন? কতজন এই সারাজীবন একটাই কবিতা লিখে গেল। নির্মল হালদার। কৃষ্ণনগরের দেবদাস আচার্য। আরও কত…

উমা- কিন্তু প্রশান্তদা, ভাস্করের ক্ষেত্রে আমি তোমাদের সঙ্গে একমত নই।

অমিতাভ- কেন?

উমা- প্রথমত ওই সময়ে ছন্দের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে টানা গদ্যে ওইরকম লেখা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেই বা করেছেন? তাছাড়া অমিতাভদা, আমিতো এই ‘আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে’ এই কাব্যগ্রন্থে কবির এক ডিপারচারকেও লক্ষ্য করি।

অমিতাভ- হ্যাঁ, ডিপারচারতো আছেই। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হল, ওই বই-এর মলাট খুলে নাম তুলে দিয়ে পড়লেও মনে হবে আমি ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতাই পড়ছি। এই যে বিষয়টা…, এই যে একটা অদ্ভুত জগৎ… এই যে চিহ্ন…

উমা- কবির সিগনেচার…

অমিতাভ/প্রশান্ত- সিগনেচার, সিগনেচার…

অমিতাভ- অনেকের মধ্যে চিনতে পারা… আলাদা করা… এটা সহজ কথা নয়। আর… 

প্রশান্ত- আরে সেইজন্যইতো এত পাগলামি সুশীলদার। সকলের থেকে আলাদা। লেখা আর ছিঁড়ে ফেলা। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা হয়ত ছিল না। কিন্তু কী খাবেন কী পরবেন কোথায় থাকবেন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না। কতদিন গিয়ে দেখেছি কিছুই খাবার নেই। তখন আবার বাড়ি থেকে খাবার দাবার নিয়ে গিয়ে খাইয়ে এসেছি। একদম অনিশ্চিত। জ্বর হয়েছে, দেখার কেউ নেই। আমিই তখন ব্যাপারগুলো ম্যানেজ করেছি। আবার খুব কষ্টও পেতেন। তাঁর প্রথম বইটা, যেটা রক্তমাংস থেকে প্রকাশ পেয়েছিল, সেটা নিয়ে সুশীলদার খুব মনকষ্ট ছিল। আসলে কিছুতেই ন্যূনতম তৃপ্তি ছিল না। সন্তুষ্ট হতে পারতেন না কবিতা নিয়ে, এসব সবাই রিয়েলাইজ করতে পারত না। বলত পাগল। একটা মানুষ, সব থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন… একা পুরো প্রথার বাইরে কবিতাচর্চা করে গেলেন… সাহস ছিল।

অমিতাভ- একবার হল কি… রাত সাড়ে দশটা। শীতের রাত। সাড়ে দশটা মানে আমাদের বহরমপুরে বেশ রাত। দরজায় টোকা। বাবা গিয়ে দরজা খুললেন। বললেন, সুশীল বাবু। আমি গেলাম, দেখি সুশীলদা। কী ব্যাপার এত রাতে আপনি? বললেন, অমিতাভ শরৎ আমার বেগুন চুরি করেছে। মানে? মানে, এই দ্যাখো, সঙ্গে নিয়ে এসছেন, এই দ্যাখো আমি বেগুন সহকারে লিখেছি কিনা, সেটা কত সাল? আর আজ উনি এই দেশ-এ বেগুন নিয়ে লিখছেন। তা আমার বেগুন কি চুরি হয়ে গেল না? 

প্রশান্ত- কী কী?

উমা- বেগুন চুরি। শরৎ মানে বোধহয় শরৎ মুখোপাধ্যায়।

অমিতাভ- হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঠিক তাই। সুশীলদা আগেই বেগুন তার মত করে কবিতায় এনেছেন। এখন শরৎ বাবু। তাই তার বেগুন চুরি হল না?
(তিনজনের হাসি, অট্ট, থামতে চায় না।)

উমা- আরে শেষদিকে পাগলামি আরও বেড়েছিল, জানোতো। বাড়ির বিষয়টা তো তোমরা জানই। একদিন আমার এই বাড়িতে ‘বৌমা…’ ডেকে ঢুকে পড়লেন। উস্কোখুস্কো চুল। প্রায় লাল চোখ। হাঁপাতে লাগলেন। আমি ভাবলাম, কী ব্যাপার এই কদিন আগেই তো মিটিয়ে দিয়ে এলাম ঝুট ঝামেলা। তো আবার কী হল? কী হল, সুশীলদা? – হ্যাঁ, তুমি ব্যাংকে কাজ কর। তুমি পারবে। তুমি এই একাউন্ট আর সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে ব্যাংকে যাবে। এর সবগুলোর নমিনি আমি তোমাকে করে দেব। বলে ইউনাইটেড ব্যাংকের দু-তিনটে সেভিংস পাসবুক আর সার্টিফিকেট টেবিলে রাখলেন। আমি তখন চা-টা খাইয়ে অন্য গল্প করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে দিয়ে এলাম। দেখলাম ভুলে গেছে।

প্রশান্ত- কত কথা যে আজ মনে পড়ছে। অফ দ্য রেকর্ড বলি, এই বিয়েটা, মানে উনার কিছু সিদ্ধান্ত…। মানে… অবধারিতই ছিল… তবু বোধহয় একটু শান্তি পেতেন…

অমিতাভ- প্রশান্ত খুব করেছে। দেখভাল… খাবার দাবার… অসুখ বিসুখ…। আমি অতটা পারতাম না। বড় পরিবারে আমি একটু বিচ্ছিন্নও ছিলাম… 

উমা- আমাকে করতে হত। তোমরা ছিলে না… কিছু হলেই নারায়ণ দা, ফোন… উমা, বুড়ো ক্ষেপেছে… একটু দেখো…। আরেকটা বিষয়… সেবারে শ্যামলদা (শ্যামলকান্তি দাশ) কবিসম্মেলনের জন্য মুর্শিদাবাদের কোনও প্রবীন উল্লেখযোগ্য কবির সাক্ষাৎকার নিতে বললেন। আমি সুশীলদার কথা ছাড়া আর কারও কথা ভাবিনি। যোগাযোগ করে, টেপ-রেকর্ডার নিয়ে গিয়ে বললাম—বুড়ো, যা জিজ্ঞাসা করব তাই বলবে। জানতাম, অনেক সময় লিংক থাকবে না। অনেক কথা তুলে ফেলবে। বলল, ঠিক আছে। ভেবেছিলাম দুটো ৯০ মিনিটের ক্যাসেটে হয়ে যাবে। তা তিন দিনে আমার চার-পাঁচটা ক্যাসেট ভরে গেল। সেগুলো বহুৎ বেছেবুছে সম্পাদনা করে রেডি করলাম। দ্বাদশীর এক বিকেলে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে ছবি-টবি তুললাম। তখনই বললেন—যা করার তাড়াতাড়ি কর। তার দুদিন পরেই সুশীলদা চলে গেলেন। পরে সাক্ষাৎকারটা কবি সম্মেলনে প্রকাশ পেল, কিন্তু সুশীলদা আর দেখে যেতে পারলেন না। (সবাই চুপ। যেন দু-মিনিটের নীরবতা পালন)।

উমা- এটা আমাদের বলতেই হবে, সুশীলদার আশ্রয় প্রশ্রয় আর উত্তরাধিকার আমাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে, বর্তেছে। সুশীলদা আমাদের গড়ে ওঠার কেন্দ্রবিন্দুতে।

প্রশান্ত- একদম। একদম। হার্ন্ডেট পারসেন্ট কারেক্ট। আমরা বহন করি।

অমিতাভ- একদম সত্যি কথা। এ নিয়ে কোনও তর্কই নেই। ওঁকে তো আমরা মানি…

উমা- এবারে সাতের দশক পেরিয়ে আসি আটের দশকে। এ দশকে বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদে ‘রৌরব’ সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মুখপত্র হয়ে ওঠে। তা এই রৌরবের সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক, যোগাযোগ, মিথস্ক্রিয়া, কবিতা, যাপন, এসব নিয়ে কথা হোক না। অমিতাভদা, তুমি বল।

অমিতাভ- সেটা নিয়ে কী আর বলার আছে…

প্রশান্ত- ওরা ঠিক করল, রৌরব বার করবে, খুব ভালো কথা। আমরা তো তখন বহরমপুরের বাইরে। তাই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কিছু ছিল না। শুভ, সমীরণ, শান্তিময় এরা আমাদের কাছে কবিতা চাইল, আমরা আমাদের সাধ্যমত কবিতা দিয়েছিলাম। একটু পরে ওরা বেশি গদ্যের দিকে ঝুঁকল, স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও লেখা গেল কমে। এই রৌরবেই আবুল বাশারের 'চোর' গল্পটা প্রকাশ পেয়েছিল।

অমিতাভ- ওখান থেকেই তো বাশারের উত্থান। তারপর দেশ পত্রিকায় চলে গেল। পরে আবুল বাশার কী করেছিল সে অন্য কথা…

প্রশান্ত- এটা ঠিক, ওরা একদম নতুনভাবে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তুমি তো রৌরবেই জড়িয়ে গিয়েছিলে। তুমিই বল না্…

উমা- হ্যাঁ, তা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমি পরে। গোড়াতে বহরমপুর ছিলাম না। ৮২র শেষদিকে ফিরে আসি। ৭৯ থেকে ৮৩র মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখালিখি, প্রকাশ, ইত্যাদিতে বেশ জড়িয়ে পড়েও আবার লেখালিখি বন্ধ করে দিই। আসলে কিছু ঠিক হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল এসব লিখে কী লাভ! চর্বিত-চর্বন মনে হচ্ছিল। ওদের কথা শুনতাম, নানা সোর্সে, পত্রিকাও দেখতাম কয়েকটা, কিন্তু সেভাবে আগ্রহ বোধ করতাম না। আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ ওদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও আমাকে সচেতন করেছিল। যাইহোক, আমার ওই বন্ধ্যা সময়ে ৮৪র ডিসেম্বর বা ৮৫র জানুয়ারিতে শুভ একদিন আমার কাশিমবাজারের বাড়িতে হাজির। উমাদা ডেকে একদম বাড়ির ভেতরে। যেন কতদিনের চেনা। ও কিন্তু তার আগে আমাকে দেখেনি কোনওদিন। আমিও না। তা, সেই শুভ আমাকে একদম হাতে ধরে বাইরে বার করল…। রৌরবে ধীরে ধীরে জড়িয়ে গেলাম। আবার লেখালিখি শুরু করলাম। আর কখনও বিচ্ছিন্ন হইনি রৌরব বা লেখা থেকে। আজও না…। চাকরি স্থানান্তরে স্থানিক দূরত্ব তৈরি হলেও একজন কর্মী হিসেবে জড়িয়েই ছিলাম। মানসিক দূরত্ব হয়নি। লেখা, পত্রিকা প্রকাশ, প্রজেক্ট কাজ, সম্পাদনা সহায়তা, সংকট, রান্নাঘর, কোর… সবেতেই ছিলাম, থাকতে হত। তা আমি যে সময়টায় জড়ালাম তখন পেলাম অনেক তরতাজা কবি লেখককে। শুভ সমীরণ শান্তি কিছুটা অচিন্ত্য সাধন গোপাল নাসের অসীম বাবুয়া (অনুপম) তাপস অজয় কৌশিক আর আংশিক বাশারদা ইত্যাদি। আর এদের কেন্দ্রক হচ্ছে শুভ। তো এদের সঙ্গে মিশে যেতে আর কাজ করতে আমার কোনও অসুবিধাই হল না। আমারও আবার লেখালিখি শুরু হল…।

প্রশান্ত- হ্যাঁ ওদের কয়েকজনের একটা রাজনৈতিক দর্শন এবং আইডেনটিটি ছিল। কিন্তু পত্রিকায় তার ছাপ খুব একটা ছিল না। বহরমপুরের আর সবাই এদের কাজ-কর্মকে সেভাবে ঠিক মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু আমরা খুব এনজয় করতাম। আবার এটাও ঠিক, পরে কখনও দু-একবার এদের ক্রাইসিসে আমিও কিছুটা জড়িয়ে গিয়েছিলাম।

অমিতাভ- আমার একটা মনে আছে। আমি তখন চাপড়ায়, প্রশান্ত বেথুয়াডহরি, তো ওরা কয়েকজন বেথুয়াডহরি এলো। আড্ডা, অনেক কথাবার্তা, সবাই ড্রাংক, বেশ পরিমাণ। তো আমি যেটা খেয়াল করেছিলাম— এরা একদম নতুন, অসম্ভব জীবনী শক্তি, একদম Full of life… এত প্রাণ ভাবা যায় না, আর চেষ্টাটাও খুব প্রাণবন্ত। পম্পুর মধ্যেও এই একই জীবনীশক্তি, প্রাণ আমি দেখেছিলাম…টের পেতাম। কিন্তু তা ছিল একক… পম্পুর পাশে সেভাবে কেউ ছিল না। কিন্তু এরা একদল…

প্রশান্ত- হ্যাঁ পম্পুরও এটা ছিল। ও চৌপর নিয়ে একটু আলাদা রকম কাজকর্মই করতে চেয়েছিল। আমি প্রথমদিকে কিছুটা ছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম, আর ছিল অরুণ চট্টোপাধ্যায় বলে একজন, একটু নতুন চলনের চেষ্টা ছিল তাতে। কিন্তু প্রথমত ও নাটকে ভিড়ে গিয়েছিল… আর দ্বিতীয়ত ওর সঙ্গে সেভাবে কেউ ছিল না…

অমিতাভ- বেথুয়াডহরিতেই শুভ সমীরণের সঙ্গে আলাপ। আমার কবিতা সম্পর্কে ওদের তেমন কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু ওদের জীবনীশক্তির উদ্দামতার প্রশংসা করতেই হয়। পুষ্পেন পুস্পেন রায় ছিলেন…

উমা- হ্যাঁ, কিছুদিনের জন্য আমার মাষ্টারমশাই ছিলেন। 'বিদিশা' বলে পত্রিকা করতেন।

অমিতাভ- হ্যাঁ, পরে 'অন্যগাঙ' নাম করেছিলেন। উনার কাছ থেকে শুনেই ওদের আসা।

প্রশান্ত- আর ওই অতগুলো তরতাজা ছেলে, সবাই কম বেশি লিখছে, প্রকাশ করছে, এটা একটা দারুণ ব্যাপার হয়েছিল… পম্পু ছিল একক, এরা সেটাকেই এগিয়ে দলবদ্ধভাবে…

অমিতাভ- আর কী সব গদ্য তখন প্রকাশ করছে, যজ্ঞেশ্বর রায়, ইউলিসিস নিয়ে… জীবনানন্দ নিয়ে… একটু পরের দিকে সব প্রজেক্ট করা কাজ। এরকম বহরমপুরে আগে আর হয়নি…। আজ হয়ত বা অনেকেই অমুক সংখ্যা তমুক সংখ্যা করছেন, কিন্তু আজ থেকে প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগে এসব ভাবাই যেত না।

উমা- হ্যাঁ। বনবিহারী চক্রবর্তী, অরুণেশ ঘোষ, বদরুদ্দীন উমর, উদয়ন ঘোষ, মাণিক মুখোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, আবুল বাশার, আরও সব লেখক তালিকায়।

প্রশান্ত- পরের দিকে রৌরব বারো বছর, আলবেনিয়া-১, ২, স্তালিন সব মারাত্মক মারাত্মক সংখ্যা।

উমা- যাই হোক, রৌরব বেশ কিছু কাজ করেছে, যা বহরমপুর তথা মুর্শিদাবাদে আগে কেউ করেনি।

প্রশান্ত/অমিতাভ- একদম। ভাবাই যায় না।

উমা- গল্পে গল্পে আমরা কখন আটের দশকের মাঝামাঝি চলে এলাম। তো তোমাদের লেখালিখি তখন কেমন চলছিল? ৭৯ থেকে ৮৩ কলকাতা ও উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকায় লেখার পর একরকম ক্রাইসিস থেকে আমার লেখা তো দু-বছর পুরো বন্ধ। নাটকে থিয়েটারে কিছুটা ঘেঁষে গেলাম। সেটাও আমার জায়গা না, বুঝতে বেশি দেরি লাগেনি। পরে শুভ আর রৌরব। আবার কিছু লেখালেখি, পত্রিকা করা, প্রকাশ, এইসব। তোমরা কবিতা পত্রিকা করলে ‘পাণ্ডুলিপি’। বহরমপুর মুর্শিদাবাদের বাইরে তোমাদের প্রকাশ বিকাশ এগুলো নিয়ে কিছু বলো। ইনফ্যাক্ট তখন তো আমরা প্রায় সকলেই বিচ্ছিন্ন।

অমিতাভ- বাইরে আর কোথায় বেশি লেখালিখি? কী প্রশান্ত তেমন কিছু কি হয়েছিল? হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গে সামান্য কিছু ছিল। তা আমরা দুজনে মিলে একটা পত্রিকা করলাম, নাম তো বললে ‘পাণ্ডুলিপি’। কিছুদিন চলল। মাত্র তিনটে সংখ্যা। আর তিনটে বই হয়েছিল। প্রশান্ত, সন্দীপদা আর আমার। তারপর চাকরির দৌলতে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া। ও পর্ব শেষ। লেখাটেখাও প্রায় বন্ধ। একদম Out of touch যাকে বলে। আমি তো ছিয়াশির পর থেকে লিখিইনি প্রায়। টুকটাক, সামান্য… বলার মত কিছু নয়। পরে আবার ৯৬ থেকে লেখালেখি একটু আধটু…

প্রশান্ত- এই চাকরি করতে গিয়ে পত্রিকা শুরু করেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। চাকরি করতে গিয়েই আমাদের যে প্রকৃত জায়গাটা সেটা প্রায় নষ্ট করে ফেলেছিলাম। প্রদীপ তো অনেকদিন লিখেইনি। আমার চলছিল… তবে সে টুকটাক…। বহরমপুরে তখন কী চলছিল বা হচ্ছিল তার সঙ্গে আমার খুব একটা যোগাযোগও ছিল না। প্রদীপের অবশ্য যোগাযোগটা ছিল। ওর যাতায়াত ছিল। তবে একটা টান তো আমার থাকতই…

উমা- ঠিকই বলেছ। এই তো ৮৫ থেকে লেখালিখি আর রৌরবে জড়িয়ে আবার ৮৮র গোড়ায় আমাকেও বহরমপুরের পাততাড়ি গোটাতে হলো, চাকরির জন্য। অবশ্য আমার যোগাযোগ, যাতায়াত, এসব ছিল। আসলে রৌরবের একটা তাগাদা কাজ করছিল। তাছাড়া কবিতা নিয়ে নিজের মধ্যে নিজের মত করে একটা ভঙ্গিও গড়ে উঠছিল। কিন্তু মুশকিল ছিল আমার যোগাযোগের। ওটা ইচ্ছে করত না। ফলে রৌরবেই আবদ্ধ থাকতাম। কোথাও লেখাপত্র পাঠাতেও ইচ্ছে করত না। আবার চাইলেও অনেক সময় এড়িয়ে গেছি। এইতো বাঁকুড়ায় ছিলাম, আট-ন বছর, তো এক কবি ঈশ্বর ত্রিপাঠি ছাড়া আমার আর কারো সঙ্গে যোগাযোগই হয়নি।

অমিতাভ- আমি আবার যখন শুরু করব বলে ঠিক করলাম, তখন নিজেই ঠিক করলাম, এবার নিজের কবিতাটা লিখব। নিজের মত করে। এতদিন তো নিজের কবিতা লিখি নি। লিখেছি প্রেজেন্টেবল কবিতা, লোকে পড়েই ভালো বলবে, বেশ বেশ করবে। এটা ভুল ছিল, ভাবনায় মারাত্মক ভুল। তাই ঠিক করলাম এবার ভেতরে ঢোকার কবিতা লিখব, আত্মস্থ করার কবিতা। ধ্যানের মত জায়গা থেকে লেখা। মনে একটা ক্ষোভ ছিল নিজের প্রতিই। একটা যাকে বলে বিবমিষাও তৈরি হল। বুঝলাম, নিজের লেখা ভাঙা দরকার। তো সেখান থেকে নিজের কবিতার একদম পুরোনো ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হল। দেখাও হলো এরই মধ্যে নানারকম, সামাজিক টানাপোড়েন, মানুষজন, চাকরির সুবাদে মরতে যাওয়া মানুষের, পোড়া মানুষের জবানবন্দী নিতে হত, ভয়ংকর, সব মিলিয়ে একটা নিজেকে মোটিভেট করা। তখন ভাবলাম, কিছুই তো পারি না, তাহলে নিজেকে একটু ভ্যাঙাই, নিজেকে নিয়ে একটু মজা করি। টোটেমভোজ, ষাঁড় ও সূর্যাস্ত এসব থেকেই… আমি এই ভ্যাঙানো মজা করা এসব বেশ এনজয় করতে লাগলাম…

উমা- রেজারেকশান অফ অমিতাভ মৈত্র…

প্রশান্ত- হ্যাঁ এই সময়কালটায় আমি প্রদীপকে একবার দেখেছি। ওর কৃষ্ণনগরের কোয়ার্টারে। কী তার পড়াশুনা। একদম নিয়মিত, আর বিচিত্র। আর ভাবছেও নতুন করে। সেই ম্যাডাম এম পর্ব…। ওর সঙ্গে অবশ্য কলকাতার যোগাযোগটাও বেশ ছিল…।

অমিতাভ- কৃষ্ণনগর উইম্যানস্ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন এক বিদূষী মহিলা। অসম্ভব সুন্দরী। তিনি গল্প-উপন্যাসকার শৈবাল মিত্রের স্ত্রী। তো এঁদের লাইব্রেরিতে প্রচুর আর ভালো বই সব। সেখানে আমার পারমিশান ছিল, নিজে দেখেশুনে বেছে ইচ্ছেমত যতগুলি খুশি বই নেওয়া। সেটা আমার কাছে বড় সুবিধার হয়েছিল। কিন্তু পড়াশুনা এসব থাকলেও তা বড় কথা নয়। বড় কথাটা হচ্ছে লেখা। আমি ঠিকই করে নিয়েছিলাম এবার নিজে যেটা লিখব বলে স্বপ্ন দেখি সেটাই লিখব। আগে যা লিখেছি সেটা Story of failure। লোকে কী বলেছে সেটা বড় কথা নয়। আমি তো জানি আমি কী? এখনও যা লিখছি, সেটাও আমি জানি। যেটা লিখতে চাই, সেটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। কিন্তু এখান থেকে এখনও আমি বেরোতে পারব না। চাইছিও না। আমার আরও বছর চারেক লাগবে। তারপর আমি শেষবারের মত একটা চেষ্টা করব। যদি কিছু করা যায়… যদি নাই হয়, তবে সেটাও হবে গিয়ে আরেকবার Story of failure

উমা- এটা তুমি বিনয় করে বলছ অমিতাভদা। আমরা তো জানি তোমার এই সময়ের কবিতা একটা নতুন ধরণের কাজ। বাংলা কবিতায় এক অনন্য কন্ট্রিবিউশান। এভাবে কবিতা হয়, করা যায়, সেটা তুমি করে দেখিয়েছ। এবং এই যে ভাষারীতি আর প্রেজেন্টেশনের মেলবন্ধন… 

অমিতাভ- না উমাপদ, বিনয় ফিনয় কিছু না। পাঠক ভালো মন্দ অনেক কিছুই বলতে পারে। আমার তাতে খুব একটা যায় আসে না। আমি চাইছি সেই জায়গাটা যেতে, যা এখনও আমি পারিনি…। সেই কেন্দ্র… বা তার কাছাকাছি… ছোঁয়ার ইচ্ছা আছে, তৃষ্ণাও আছে… দেখি তার কাছাকাছি যেতে পারি কিনা!

উমা- সে তো ঠিকই। সন্তুষ্টি বা তৃপ্তি তো আসতেই পারে না। সেটা চলে এলে তো আর কবিতাই হতে চাইবে না…। এই যে প্রশান্ত দা, প্রশান্তদাও একটা প্রচণ্ড ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের এক চলনে শুরু করল ‘স্ব-বিষয়ে দু-চার বাক্য’ থেকে। সেখানেও আমরা এক মার্ভেলাস কাজ পেয়ে চলেছি। সাধু ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে সমকালকে আর নিজেকে এমনভাবে ভাবা আর তা প্রয়োগ করে দেখানো, সোজা কথা নয়। 'কাহাদের কথা' তো অনবদ্য…

অমিতাভ- ভাবা যায়! কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছে। কী তছনছ করে দেওয়া। এভাবে ভাবেই নি কেউ। এই দু-একজন ছাড়া। তবু আমি বলব, প্রশান্ত নিজের কবিতাই লিখেছে, প্রথম থেকেই। বেসিক-টা একই, এখন হয়ত ভাষা, বলার ধরণে অনেক পরিবর্তন এনেছে, ভাবনাতেও এনেছে নানারকম দিক, একটা পরিশীলন, সহজ রাস্তা ছেড়ে ধরেছে একটা জটিল রাস্তা, কিন্তু সেটা প্রশান্তরই। আর শুধু প্রশান্তই কেন, তুমিও কবিতা নিয়ে অনেক ভালো কাজ করেছ, করে চলেছ। ওই যে বইটা, যেটা নিয়ে আমি একটা গদ্যও লিখেছিলাম, হ্যাঁ ‘পরিযায়ী চলো’। সেখান থেকে তো তুমি একদম অন্যরকম। সেটা তোমার আগেও ছিল। কিন্তু এর পর থেকে সেটা একটা নিজস্বতার দিকে চলে গেল। তখন থেকে তুমি যা লিখেছ তা শ্রাবস্তী বা রৌরব পর্ব থেকে একদম আলাদা। আমি তো অনেক সময় অবাকই হয়ে যাই, কতভাবেই না বাংলা কবিতা… এগুচ্ছে… মানে একটা এগিয়ে যাওয়া… 

প্রশান্ত- উমা তো সম্পূর্ণ ধারার বাইরে লেখে। কারো মত করে লেখে না। প্রচুর ছোট ছোট কাজ থাকে ওর কবিতায়। আর ভাষাটাও একটা ফ্যাক্টর…, আমার তো একটা আবেশ তৈরি হয়ে যায়… তো এসবই তো বাংলা কবিতায় হওয়া দরকার। হচ্ছেও…

উমা- নয়ের দশকের গোড়ার দিকে আমরা দুটো কবিতা ধারা জন্ম নিতে দেখলাম। এক ‘নতুন কবিতা’ এই কয়েনেজে এক রকম, আর ‘পোস্টমডার্ণ কবিতা’ এই নামে আরেক। তো এই দুটো আলোড়ন আন্দোলনের প্রভাব কেমন মনে হচ্ছে, এই নিয়ে তোমাদের কী মত, কীরকম সব চিন্তা ভাবনা, কী মনে হয়?

অমিতাভ- আমি সেভাবে কিছু ভাবিনি। তবে এটা বলতে পারি, প্রভাত দার কবিতা ঠিকই আছে। বেসিক্যালি উনি কবি। আর সমস্ত যাই থাকে, থাকুক। তিনি একজন কবি। ওঁর কবিতায় চমক ছিল, থাকে। তা, থাক না চমক, চমক থাকলে কি কবিতা হয় না? চমকের মধ্যে একটা ঝাঁকিও থাকে। চমক কিন্তু আলটিমেটলি খারাপ কিছু নয়। সুশীল দা বলতেন—ধুর এসব সব স্টান্ট। আমি তো আরও অনেকের কবিতার মধ্যেই এই Stunt পাই। তুষার রায়-এ স্টান্ট ছিল না? ফাল্গুনী রায়-এও ছিল। কিন্তু কবিতাটা তো বাতিল করে দিতে পারি না। স্টান্ট যদি কবিতায় মিশে যায়, তাকে কি আমরা সরিয়ে রাখতে পারব? কেউ কেউ দেখি, একটা কবি কবি ইমেজ তৈরি করে নিয়ে একটা কবি কবি ভাব নিয়ে কবিতা লিখছেন। সেটা কি খুব বড় কথা? আর দ্যাখো, যে কোনও ইজম দেখে তো কবিতা লেখা হয় না। লেখাটাই আগে, তারপর তার ব্যাখ্যা ট্যাখ্যা… । সুররিয়ালিজম… তা আদ্রে ব্রেঁতোর ম্যানিফেস্টো দেখে, পড়ে, পরে দালি আঁকতে আরম্ভ করলেন, তাই আবার হয় নাকি? তাহলে এইসব আঁকা বেরোতো? এই কল্পনার এমন বিস্তার। আবার দালি বলছেন- “I am the Surrealism” । ফলে এই সব আন্দোলনগুলোর আমার কাছে তেমন গুরুত্ব কিছু নেই। 

উমা- পোস্টমডার্ণ কবিতা আলোড়ন?

অমিতাভ- বললাম তো আমার ধারণাও নাই, বিশ্বাসও করি না। এত ভাবি টাবিও না। প্রভাত দা আমাকে কবিতা পাক্ষিকের জন্য গদ্য লিখতে বললেন। তা আমি পোস্টমডার্ণ কী লিখব? আমি করলাম কি হয়ত গোর্কির গল্পের একটা অংশ নিয়ে, আলবেয়ার কামুর নাটকের একটা অংশ নিয়ে মিলিয়ে মিশিয়ে একটা গদ্য দাঁড় করিয়ে দিলাম। প্রকাশ পেলে লোকে এটা বেশ খেল, মানে কিছু পাঠক পড়ল। তা একদিন সুধীর দত্ত ফোন করে জানালেন—এই যে এতদিনে কবিতা পাক্ষিক একজন মনমত গদ্যকার পেয়েছে। আমি হাসলাম। তা উনি আরও বললেন—কিন্তু প্রভাত বাবু কি বুঝতে পারছেন না, যে আপনি আদৌ কোনও পোস্টমডার্ণ গদ্য লিখছেন না। আমি বললাম—না, লিখি নি তো।

উমা- আর 'নতুন কবিতা'?

অমিতাভ- ওই একই। সব সময় স্কুলিং দিয়ে কবিতা লেখা যায় না। উচিতও না…। সত্যি বলতে কি এসব নিয়ে বেশি ভেবে লাভও কিছু নেই। এই যেমন শব্দসৃষ্টি। যে সমস্ত শব্দ আছে, তা দিয়ে আর কবিতা লেখা যাবে না, এটা আমি মানি না। হ্যাঁ শব্দ সৃষ্টি চলতে পারে, কিন্তু ওটা না হলে সম্ভব নয়, এটা ঠিক নয়। এই যে প্রশান্ত এইসব কবিতা লিখেছে তাতে তো সবই পুরোনো আর চেনা শব্দ। তা দিয়ে কি কবিতা হচ্ছে না? অন্যরকম হচ্ছে না? তুমি করছ, কটা নতুন নতুন শব্দ আছে? গুটিকয় হয়ত বা, ভয়ংকর কিছু তো নেই। তাতে কি কবিতা লেখা হচ্ছে না, তোমার কবিতা কি নতুন নয়, অন্যরকম নয়? চেনা শব্দের পাশে আরেকটা চেনা শব্দ বসিয়ে একটা নতুন ইমপ্যাক্ট তৈরি করা, এটাই তো কবিতার কাজ, এখানেই তো তার রহস্য। এই প্রশান্ত, তুই চুপ করে আছিস কেন, বল কিছু…

উমা- বলবে বলবে। তোমার শেষ হলেই বলবে। শব্দ ছাড়াও নতুন কবিতায় আরও অন্যরকম ভাবনা চিন্তাও ছিল, আছে।

অমিতাভ- হ্যাঁ, তা আছে। বারীন দা তাঁর নিজের মত করে কবিতা লেখে। এটা তাঁর নিজস্বতা, তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। তাঁর ন্যাচারাল ব্রিদিং-এ এটা মিশে আছে। কিন্তু দেখা যায় তাঁর মত করে, অনেকে একদম কপি করে লিখছে। এটা ভালো না। কেউ কেউ হয়ত এমন আত্মস্থ করে ফেলেছে যে তার থেকে আর বেরোতে পারছে না। তবে বারীনদার গদ্য অসাধারণ। আমি বেশ কিছু পড়েছি। খুব ভালো, উদ্দীপক… একদম ভেতরে নিয়ে যায়।

উমা- সে আর বলতে। অসাধারণ গদ্যের হাত। কতসব প্রশ্ন, আর উত্তর খোঁজা। আর একদম একটা সহজ ভঙ্গিতে। আমার অবশ্য বারীন দার কবিতাও খুবই ভালো লাগে, অসম্ভব সব ভাবনার ফলিত রূপ বলে আমার মনে হয়। যাক, সে অন্য প্রসঙ্গ।

প্রশান্ত- বারীনদা, গদ্যে প্রচুর প্রশ্ন তোলে, উত্তর খোঁজে, আর তার সঙ্গে আমাদেরকেও জড়িয়ে নেয়। তখন ভাবা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

উমা- হ্যাঁ, প্রশান্তদা, তুমি বলো, পোস্টমডার্ণ কবিতা, নতুন কবিতা…

প্রশান্ত- হ্যাঁ। আলোড়ন আন্দোলন এগুলো সবসময়ই প্রার্থিত। নয়ত জড় হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রশ্নটা যদি ব্যক্তির হয়, যদি আমার কথা বলি, আমি নিজে কোনওদিন কোনও তত্ত্বকে সামনে রেখে কবিতা লিখি নি, লিখি না। আমি আমার মত করেই চেষ্টা করি। আমার কবিতা নিয়ে অনেকেই অনেক কিছু বলেছেন। কেউ বলেছেন অধুনান্তিক, কেউ পোস্টমডার্ণ, কেউ বা নতুন কবিতা, কেউ আবার অপর কবিতা। তা, তারা বলেছেন, তাদের মনে হয়েছে, বলেছেন। এতে আমার কবিতা তো পালটে যাবে না। আমি চেয়েছি স্বাধীনভাবে লিখতে। কেননা, আমি জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পরাধীন। সমাজে পরাধীন, পরিবারে পরাধীন, রাষ্ট্রে পরাধীন। তা এই একটা মাত্র ক্ষেত্রে আমি স্বাধীন থাকতে চেয়েছি। কবিতায় আমি স্বাধীন। কবিতায় আমি একদম নিজের ইচ্ছেমত চলব। তা এই স্বাধীনতার স্বাদ আমার মধ্যে যিনি প্রথম উস্কে দেন, তিনি হচ্ছেন প্রভাত দা। প্রভাতদাই আমাকে নিজেকে খুলে ধরতে বলেছেন। তারপরে পেয়েছি সমীরদাকে (সমীর রায়চৌধুরী)। তারপর বারীনদা। এঁরাই আমাকে একটু একটু করে তেল জুগিয়ে গিয়েছেন। তা তোমরাই কি আমাকে কম ইন্ধন জুগিয়েছ, উদ্বুদ্ধ করেছ? এই যে লেখার প্রকরণ, তার প্রথম বই ‘স্ব বিষয়ে দু-চার বাক্য’, তাকে নিয়ে তো তুমি একটা গদ্যও লিখেছিলে। আর শব্দ নিয়ে প্রদীপ যা বলল, তা শব্দ নতুন সৃষ্টি করা হোক না, অভিনন্দন, বেশ ভালো কথা। যদি নতুন শব্দ সৃষ্টি করা যায়, আর তা দিয়ে কবিতাই হয়ে ওঠে, তার চেয়ে মঙ্গল তো আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু কাজটা আমাকেই করতে হবে, এর কোনও মানে নেই। যদি পারি, সেটা ভালোই হবে। বাংলা কবিতায় একটা কন্ট্রিবিউশন হবে। 

উমা- হুঁ। তোমাদের কথা বললে। আমার মনে হয় এসব আলোড়ন আন্দোলন যত হবে, তত সমৃদ্ধ হওয়া যাবে। কিন্তু ম্যানিফেস্টো, সে লিখিতই হোক আর অলিখিতই হোক, যদি তা কালে কালে পায়ে বেড়ি লাগানোর কাজেই ব্যবহৃত হয়, তাহলে তা একটা সুকুমার শিল্পের জন্য ভালো হতে পারে না। যদি এগুলো দল উপদল বা গোষ্ঠী তৈরি করার জন্যই সীমাবদ্ধ থাকে বা রাখা হয়, তাহলে তার ভালো ফল না মিলে কুফলগুলোই প্রকট হয়ে উঠবে। আমার মতে সব কবিই নতুনের অভিসারী, সে দল বেঁধেই হোক, আর একাকীই হোক। সে নিজের চলন ও স্বর খুঁজে বেড়ায়, পায়ও। সবাই যে এই অভিসারে শেষ পর্যন্ত থাকে, তা না, নানারকম চাপ, সম সময়ে বিখ্যাত হওয়ার ইচ্ছা, মিডিয়ার প্রলোভন, পুরষ্কারের আশা ইত্যাদি নানা কারণে অনেকেই হয়ত এই অনুসন্ধিৎসার জার্ণিটা বন্ধ করে দেন। আবার অনেকেই নিজের মত করেই পথ বেয়ে যান। মুশকিলটা হচ্ছে এখন একটা ছাপ মেরে দেওয়ার প্রবণতা। কোনও একজন কবিকে ঠিকভাবে না পড়ে, তার চলার তরিকা, কবিতার কা্জ, ইত্যাদির বিশ্লেষণ না করেই, হয়ত শুধু মাত্র মেলামেশা আর বন্ধুত্বের জন্য ছাপ মেরে দেওয়া হয়। এ নতুন কবিতা লেখে, এ পোস্টমডার্ণ, ও অপর কবিতা, ইত্যাদি। এতে আখেরে কিছু লাভ হয় না। আমি দেখেছি, যেহেতু অন্যরকম লেখার চেষ্টা করি, তাই মূল-স্রোতের অনেক পত্র-পত্রিকা সম্পাদক ধরেই নেন, এ অমুক পন্থার কবিতা লেখে। পড়েই না হয়ত, তার আগেই ছাপ মেরে দেওয়া। আবার পোস্টমডার্ণ নতুন কে বলে, অপর নতুন কে বলে, নতুন আবার তাদেরকেই বলে। কতটা তত্ত্বগত আর কতটা দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যে বা কতটা কবিতা বহির্ভূত কারণে তা সবসময় বোঝা যায় না। তা এসবও চলে। এতে বাংলা কবিতার কী অগ্রসরমানতা ঘটে তা আমি জানি না। আমার কবিতার ভাব-ভাবনা তো আর কারো বা আরও কাদের কবিতা ভাবনার সঙ্গে অনেকাংশেই মিলতে পারে, আবার বেশ কিছু নাও মিলতে পারে, তাতে তো কিছু যায় আসে না। দেখতে হয় প্রয়োগ। কবিতা যিনি লিখছেন, তিনি তো একক, ইণ্ডিভিজুয়াল, তার কবিতা, তারই সাধনা। সুতরাং এই ছাপ মারার বিষয়টা একটা অর্থহীন প্রয়াস। আন্দোলন আলোড়ন নিঃসন্দেহে আমাদের অগ্রসর হতে শেখায়, অনেক প্রশ্ন তোলে, কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর যদি সবাই একইভাবে ভাবে, তবে অগ্রসরমানতা থাকে না। আর অন্যর মত করে যদি কবিতা লেখা চালিয়ে যেতে হয়, তাহলে আর কবিতা লেখার কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে বলে আমি মনে করি না।

অমিতাভ- ঠিক বলেছ। আমাদের অগ্রসর হতে সাহায্য করে। কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব চলার একটা পথ আর গতি আছে। যদি তা কারো না থাকে, তবে সেটা তার সমস্যা।

প্রশান্ত- উমা, তবু বলছি এসব চলবে। আমাকেও কতজন কতভাবে বলে। এর মধ্যেই চলতে হবে।

উমা- যাক, আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এই যে মোবাইল চলে এল আমাদের সংসারে পরিবারে সমাজে, তার আগে টিভি এসেছে, কম্পিউটার এসেছে, পৃথিবীটা অনেক ছোট হয়ে গেল, এর প্রভাব আমাদের ওপর কীরকম? 

অমিতাভ- এটা তো প্রয়োজন। দরকার। এতে অনেক সুবিধে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এসব এসেছে। তা এর সঙ্গে কবিতার সম্পর্কটা কী?

উমা- সম্পর্ক টা হলো, এই যে এসবের হাত ধরে চলে এল আরেকটা মিডিয়া, সোস্যাল নেট ওয়ার্কিং মিডিয়া, এলো নানা ওয়েব-পত্রিকা আর ব্লগ-পত্রিকা, এখন তো আমার মনে হয় এইসব পত্রিকার সংখ্যা প্রিন্ট-পত্র-পত্রিকার সংখ্যার চেয়ে কম কিছু নয়। ফলে এর প্রভাব কবিতায়, কবিতে, পাঠকে কিভাবে পড়ছে, আর প্রভাবটাই বা কিরকম? এর মধ্যে কি কোনও সংঘাত থাকতে পারে?

অমিতাভ- আমি ঠিক জানি না। আমি অশিক্ষিত। আমি এসব খুলতে পারি না। এই সময়ে বসে যে এসব করতে বা খুলতে টুলতে পারে না, সে তো অশিক্ষিতই। এটা সবারই ভাবা উচিৎ। কিন্তু যারা ওয়েব-ম্যাগ করে, তারা চাইলে আমি লেখাপত্র পাঠিয়ে দিই। কাউকেই প্রায় না করিনা। শুনেছি, এসব ভালোই চলে, সাড়া ফেলে। চলুক না। ঠিকই আছে। ভালই তো। এর প্রভাব নিয়ে আমার খুব ভালো একটা ধারণা নেই। কিন্তু অনেকেই ফোন করে জানায় আমার লেখাপত্র নিয়ে অনেক পাঠকের মতামত, প্রতিক্রিয়া। কবিতায় এর কী প্রভাব পড়তে পারে? তেমন কিছু না। হ্যাঁ, কবির সংখ্যা নিশ্চয়ই বাড়বে। বেড়েছেও। পাঠকের সংখ্যাও নিশ্চয়ই বাড়বে। আর ভালো মন্দ সে সব জায়গাতে একই থাকবে। কারণ কবি তো একই প্রায়। সে প্রিন্ট পত্রিকায় যা লিখবে, ওয়েব পত্রিকাতেও তাই লিখবে।

প্রশান্ত- আমার তো ব্যাপারটা খুব আশা-ব্যঞ্জক মনে হয়। আমি এই সমস্ত ব্লগ ওয়েব ম্যাগ-এ খুব ভালো ভালো লেখা পাই, পড়ি। কবিতা গদ্য। আরেকটা ব্যাপার, সেখানেই পাওয়া যায় কিছু পাঠকের মতামত, প্রতিক্রিয়া। একদম চটজলদি তাৎক্ষণিক ব্যাপারটা। এর একটা ভালো ইমপ্যাক্ট আছে। হ্যাঁ এটাও ঠিক, অনেক সময় বেশ কিছু কবিতা পড়ে খুব হাসিও পায়। 

উমা- প্রিন্ট পত্রিকায় তুমি কি হেসে ফেলার মত কবিতা পাও না?

প্রশান্ত- হ্যাঁ, পাই তো। তাই তো বলছি, ভালো-মন্দ কবিতা অ-কবিতা এসব সব কিছু নিয়েই দুটো ক্ষেত্রেই কাজ হচ্ছে। ফলে পরিধিটা বেড়ে গেল না? এ দুটোর মধ্যে আপাতভাবে কোনও বিরোধ আছে বলে আমার মনে হয় না। যে যেখানে ভালো মনে করবে লিখবে, দু-জায়গাতেও লিখবে। যে যেখানে খুশি পড়তে পারে, দু-জায়গাতেও পড়বে। এটা তো ভালো কথা। বিজ্ঞান প্রযুক্তির সুফল, এসবও কাজে লাগুক। আমরা সমৃদ্ধ হই। আর একটা দিন আসবে যখন এই ওয়েব ব্লগ সোসাল-নেট ওয়ার্কিং, ওই যে প্রদীপ বলল না, একটা নেসিসিটিতে পরিণত হয়ে যাবে। 

উমা- এতে প্রিন্ট পত্রিকার পাঠক কি কমে যাচ্ছে বলে মনে হয়?

প্রশান্ত- নট এট অল, একদম তা মনে হয় না। তা যা আছে তাই থাকবে। আমার মনে হয়, এই ছাপা অক্ষরের পাঠক থাকবেই, কোনওদিন তা কমবে না। আর পাঠক কি খুব বেশি ছিল কোনওদিনই, বিশেষত কবিতার ক্ষেত্রে? কবিতার খুব বেশি পাঠক কোনকালেই ছিল না। আজও থাকবে না। কেন যে আমরা হা-হুতাশ করি! হয়ত অনুপাতে পাঠক কমেছে, কিন্তু সংখ্যায় তো বেড়েছে।

উমা- আমার আরেকটা দিক মনে হয়। এই যে নতুন প্রজন্ম, এরা এসবে ওয়েল ইকুইপড, অভ্যস্ত, সোস্যাল নেট-ওয়ার্কটা এরা খুব ভালো ব্যবহার করতে পারে। ফলে এই সমস্ত পত্র-পত্রিকার প্রতি এদের আগ্রহও বেশি। এই আগ্রহ থেকে প্রকাশজনিত ইচ্ছা কিন্তু অনেক বেড়েছে। আমি তো অনেকেই দেখতে পাই যারা এই মিডিয়ায় লেখালিখি শুরু করে সে কবিতাই হোক, আর গল্প গদ্যই হোক, প্রিন্ট পত্রিকাতেও চলে এসেছে। এই যে পরিসরের বিস্তৃতি, এই যে লেখার প্রতি আগ্রহ, ওদের মতে এই যে পড়ার সহজ ও ভালো সুযোগ, এসব মিলিয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি কবি সাহিত্যিক শিল্পী এতে জড়িয়ে পড়েছেন। এটা নিসন্দেহে একটা বড় ধরণের পরিবর্তন। আরেকটা কথা, এই যে সব নতুন নতুন ছেলে মেয়ে লিখতে এলো, তারা লেখার সুযোগটাও তো পাচ্ছে। শুধু প্রিন্ট পত্রিকাই চললে এদের লেখা প্রকাশের ব্যাপারটা অনেকটা মার খেত। আর পত্রিকার মান বা লেখালিখির মান দু-জায়গাতে একই বলে আমার মনে হয়। আমার জানা কিছু ওয়েব পত্রিকা তো মার্ভেলাস সব কাজ করছে। 

অমিতাভ- করছে তো। এই যে তুমি নতুন প্রজন্মের কথা বললে, এরাতো এসবের জন্য একদম তৈরি হয়ে আসছে। ভালো খারাপ সব সময়ই ছিল এখনও আছে, থাকবে। সে দু জায়গাতেই থাকবে। সার্বিকভাবে খারাপ কবিতা বলে তো কিছু হয় না। হয়ত আমার ভালো লাগল না। কিন্তু এই যে কবির সংখ্যা বেড়ে গেল, সেটা তো কম কথা নয়।

উমা- আর কবিরাও কবিতার পাঠকের একটা বড় অংশ। 

অমিতাভ- ইয়েস। এদের জানার পরিধি বেশি। এই মিডিয়াই এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে। শুধু প্রিন্ট মিডিয়ায় এটা কখনই সম্ভব হত না। কবিতার জন্য তৈরি হওয়া খুব জরুরি। সেটা ওরা অনেক সহজেই পারছে। সুযোগ অনেক বেশি। আমাদের সময়ে আমরা এক দুজনের কবিতা পড়েই কবিতা লিখতে শুরু করে দিয়েছি। সুকান্ত তো সুকান্তই সই। ব্যাস, শুরু। আর এরা রীতিমত দেখে পড়ে তারপর শুরু করছে। আমাদের একটা বই সংগ্রহ করতে ঘুরে ঘুরে মরতে হত। এর তার কাছে খোঁজ, আপনার কাছে রবার্ট ফ্রস্ট আছে? আপনার কাছে? এদের তো তা না, নেটের দৌলতে চাইলেই পড়তে পারে। 

উমা- একদম ঠিক। আরেকটা ব্যাপারও দ্যাখো। এরা কত সিলেক্টিভলি পড়তে পারে। এটাও একটা গুণ। আমরা তো যা পেয়েছি নির্বিচারে পড়েছি। পঞ্জিকার রাক্ষুসে মুলোর বিজ্ঞাপন যেমন, তেমন হয়ত সত্যেন দত্ত, আবার কাফকা পড়ছি তো পড়ছি বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম এর মত থান ইট। ফলে কোনও বাছাই করার বিশেষ প্রয়াসই ছিল না। না-পাওয়া জনিত কারণও ছিল এর পেছনে। সামর্থও ছিল কম। এখন গড় সামর্থ অনেক বেড়েছে। আমাদের সময় একজন কবিতাকারির মকসো পিরিয়ড ছিল বেশ বড়। আজ কিন্তু এই কবিদের মকসো পিরিয়ড উল্লেখযোগ্যভাবে কম। আমার তো এগুলো খুবই পজিটিভ দিক বলে মনে হয়। কিন্তু দেখেছি, অনেকেই বলেন এই প্রজন্মের ছেলেরা বেশি আত্মকেন্দ্রিক, কিছুটা স্বার্থপর, ডিফাই ডিনাই করে। আমি কিন্তু সেরকম কিছু দেখিনা, অভিজ্ঞতায় নেই।

প্রশান্ত- দ্যাখো, স্বার্থপরতা খারাপ কিছু নয় কিন্তু। আমি নিজেরটা দেখব বুঝব ঠিকঠাক নেব, এটা কোনও স্বার্থপরতাই নয়। বরং স্বাভাবিক। আর আজ কেন? কোনদিনই বা তা ছিল না? সব সময় ছিল। স্বার্থপরতা সেটাই, যদি আমার বুঝে নেওয়াটা অন্যকে আঘাত করে, ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরা যথেষ্ট পরিণত, যথেষ্ট বুঝদার, এদের চলা কি আমাদের চলার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে?

অমিতাভ- আমি দেখেছি এরা এপ্রিসিয়েট করতে জানে। এই যে আমি লিখি, কী এমন লিখি? কিন্তু তার যে ফিডব্যাক, আমার কাছে হয়ত সরাসরি আসে না, কিন্তু খবর তো পাই, কী খুঁটিয়ে সব পড়ে আর তাদের সব পজিটিভ মতামত জানায়। চিনি না জানি না তারা সব এসব এপ্রিসিয়েট করে। ভাবা যায়? এটা কিন্তু আগে এতটা ছিল না। এরা আমার কবিতা নিয়ে পাঁচজনের কাছে বলে। কই আমি তো উমাপদর কবিতা নিয়ে পাঁচজনকে বলি না, পড়াই না।

উমা- (হেসে) না অমিতাভ দা তুমি আমার কবিতার বই নিয়ে দারুণ গদ্য লিখেছ। দু-দুবার। অনেকে আমাকে বলেছে, এই হচ্ছে লেখা, কীভাবে কবিতা পড়তে হয়, সেটা খুব জানার শেখার, সেটাও একটা শিল্প।

অমিতাভ- সে বাদ দাও। এরা যেভাবে জানছে, পড়ছে, এপ্রিসিয়েট করছে, কাজকর্ম করছে তা আমরা পারিনি। আমরা করিনি।

প্রশান্ত- আমাদের সুযোগ ছিল সীমিত। এদের অপশান কত বেশি। এরা অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। হাতের কাছেই সব মজুত। চাইলেই পেতে পারে। এবং এই সুযোগটা এরা নিতে পারে। হ্যাঁ ওয়াকিবহাল থাকার চেষ্টাটাও আছে… জগৎটাও কিছুটা আলাদা।

উমা- তাহলে একটা একাল সেকাল চলেই এল। এই দুই কালে কেমন পার্থক্য তোমরা অনুভব করো, সে শুধু জনজীবন যাপন এই সুবাদেই বলছি না, বলছি শিল্প সাহিত্যের নিরিখে আর কাব্যচর্চার বিষয়েও।  

প্রশান্ত- একদম আকাশ পাতাল। কোনও তুলনাই চলে না।

অমিতাভ- আচ্ছা উমাপদ, ১৮ বছরের বা ৩০ বছরের তোমার সঙ্গে আজকের ৬০ বছরের তোমার, তুমি তুলনা করতে পারো?

উমা- না, তা পারি না। বিশেষত আবেগ উচ্ছ্বাস-এ তো নয়ই। অভিজ্ঞতা বিচিত্র ও আলাদা। গুণগতভাবে তো পারিই না, হয়ত পরিমাণগত ভাবে কিছুটা পারি।

অমিতাভ- তাহলে! এটা পারা যায় না। সেটা সেই সময়ে এটা এই সময়ে। আর লেখালিখির তো কোনও তুলনা হতে পারে না। সেটা তো একটা ধারাবাহিকভাবে হয়ে চলেছে। চলবে।

উমা- It’s a flow

অমিতাভ- ইয়েস, It’s a flow । হয়ে আসছে, চলছে, চলবেও। কোনও তুলনা টুলনা হতে পারে না। সেই সময়ে যেটা স্বাভাবিক, সেটা হয়েছে, এখন যেটা সম্ভব সেটা হচ্ছে। আমার তো তাই মনে হয়। প্রশান্তর কি মনে হয় জানি না।

প্রশান্ত- আমারও তাই মনে হয়। তুমি কোন ক্ষেত্রের কথা বলছ? রাজনীতি?

উমা- না শুধু রাজনীতি সমাজনীতি ধর্ম নয় শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির কথাও বলছি।

প্রশান্ত- শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির কথা যদি বলো, তাহলে আমাকে একটা কথা বলতেই হয়। সেটা হলো সেকালে যাঁরা এই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের অনেক পরিশ্রম করে একটা একটা করে ধাপ পেরিয়ে কোথাও গিয়ে পৌঁছুতে হত। আজ কিন্তু…, আজকের তরুণরা সহজেই অনেক বেশি এনলাইটেনড্। প্রযুক্তির সহায়তায় বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে বা ধারাবাহিকভাবে কী হয়ে আসছে তা তাদের জানা। ধাপগুলো পেরোতে তাই আর ততটা পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। সেই সময় এই সুযোগগুলো ছিল না। ফলে একটা হ্যান্ডিক্যাপড্ অবস্থায় থেকেও যারা নানান ভাঙচুরের কাজ করেছেন, এগিয়ে গিয়েছেন, আজও তাদের আমরা মাথায় করে রাখি। তাদের পরিশ্রম নিষ্ঠা আর ত্যাগকে স্মরণ করি। আজকেও যে সমস্ত কাজ হচ্ছে তা বিস্ফোরক। সে ইনস্টলেশনেই হোক, ফিল্মেই হোক, পেইন্টিংস কিংবা ভাষ্কর্যেই হোক। কবিতাতেও এই পশ্চিমবঙ্গে যা কাজ হয়ে চলেছে তা বিশ্বমানের। এই আন্দোলন আলোড়নগুলোই ধরো না। এসব বাংলা ভাষাভাষি ছাড়া ভারতে আর কোথায়ইবা হয়েছে? বঙ্গভাষীরা নিরন্তর মগজ খাটিয়ে একটার পর একটা কাজ করে গেছে, একটার পর একটা ধাপ পেরিয়ে চলেছে। আগামীতেও চলবে। এই যে যাত্রা, তা কোন কম কথা নয়।

উমা- ঠিকই বলেছ। আমি এই প্রজন্মের মধ্যে আরও কিছু দেখতে পাই। দ্যাখো, এরা অনেক কিছু আত্মস্থ করে যে ভাষায় যে চিন্তা চেতনায় কবিতা গল্প গদ্য করছে তা রীতিমত গর্ব করার। আরেকটা বিষয়, ঠিক এই সময়ে আমি অধিকাংশকেই দেখছি খুব বেশি একটা প্রত্যাশা নিয়ে, খুব একটা লালায়িত হয়ে, বড় হাউস বা মিডিয়ার আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে সাহিত্য করবে, সেভাবে আসছে না। প্যারালাল বা অন্য ধারাগুলো মেন স্ট্রিমের সমকক্ষ হয়ে পড়ায় প্রকাশের বিষয়টাই প্রাধান্য পাচ্ছে। বড় মিডিয়া বড় পত্রিকা এসবে হামলে পড়ছে না। ব্যতিক্রম আছে, থাকতে পারে। কিন্তু আমার দেখা অধিকাংশই বড় সচেতন এসব বিষয়ে। আর কী সব পত্র-পত্রিকা করছে। একটা বিশেষ সময়ে সিনিয়রদের আশ্রয় প্রশ্রয় পুরস্কার টুরস্কার এসবের ক্রেজ বেশ কিছুটা হলেও এখন কমেছে। আমি জানি, বেশ কিছু আছে যারা এই দলে পড়ে না। কিন্তু আমার মতে এটা বেশ ভালো লক্ষণ। এগিয়ে থাকাদের প্রতিষ্ঠানকে সেভাবে আর পাত্তা না দেওয়া…

প্রশান্ত- প্রতিষ্ঠান। এই আরেকটা শব্দ। এটা এলে আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাও আসে। এটা কিছুদিন ধরে খুব চালু। 

উমা- কিছুদিন কেন প্রশান্ত দা, অনেকদিন ধরে এটা চলছে, সেই পাঁচের দশকের কথা ভাবো না, ষাটের দশক, সব দশকেই ঘুরে ফিরে কথাটা এসেছে। হ্যাঁ, এটা হতে পারে বা হয়েছেও যাঁরা বা যিনি এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব ছিল/ছিলেন ধুন্দুমার করেছিল/করেছিলেন তাঁরা বা তিনিই পরে প্রতিষ্ঠানের মাখন সবচেয়ে বেশি খেয়েছেন। 

প্রশান্ত- দ্যাখো, প্রদীপ বা আমি যে লেখালিখি করতে এসেছিলাম, তাতে আমাদের কাছে উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট ছিল না। কী লিখতে হবে, কিভাবে লিখতে হবে, কেনই বা! ব্যক্তিগত বোধ, বাইরে ঘটে চলা ঘটনা, আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতার প্রেরণা ইত্যাদি নিয়ে লেখালিখি, কে গ্রহণ করবে কে করবে না তা নিয়েও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আমাদের সে সময় দেশ ছিল সেই পত্রিকা যাকে আদর্শ চিহ্নিত করা হয়েছিল। তা দেশ-এ আমাদেরই অনেকেই কোনও না কোনও কারণে কবিতা লিখেছে, আবার অনেকে লেখেনি। কিন্তু তাতে আমাদের আনন্দ বা দুঃখ কিছু ছিল না। 

অমিতাভ- জাস্ট একটা ঘটনা।

প্রশান্ত- হ্যাঁ, একটা ঘটনা মাত্র। কিন্তু আমরা আমাদের লেখাটাই লিখে যেতে চেয়েছি। তাকে প্র্তিষ্ঠান কিভাবে কি দেখল, তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আজ প্রদীপ যে স্পর্ধায় কবিতা লিখে যাচ্ছে, তা যদি প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করত, তাহলে প্রতিষ্ঠানেরই লাভ হত। প্রদীপের বাড়তি লাভ ক্ষতি কিছু হবে না। ও ওর মতই লিখবে।

উমা- ঠিক তাই। কিন্তু উল্টোদিকে আমি এও দেখেছি, একদম নতুন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি চিন্তা-চেতনা নতুন বাকরীতি নিয়ে লিখতে শুরু করে, শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের চাপে, লোভে, প্রতিষ্ঠানেরই স্টিয়ার করা রাস্তায় ফিরে যেতে। মানে প্রতিষ্ঠানের উলটো পথে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের ছায়ায় মিলিয়ে যাওয়া, মানে প্রতিষ্ঠানের মত করেই নিজেকে বা নিজস্বতাকে ডুবিয়ে মারা। মানে লোভ মোহ এসব ছাড়তে না পারা। এর উল্টোটা তেমন দেখতে পাই না। এতে সাহিত্যের স্বাভাবিক অগ্রসরমানতা তো ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলেই আমি মনে করি।

অমিতাভ- দেশ-এ একটা চটক আছে, চমক আছে, একটা প্রচার পায়, প্রকাশ পেলে হয়ত অনেকে যোগাযোগ করে… এই কবিতা পড়লাম, কিন্তু সেটাই কি সব?

প্রশান্ত- আরে বাবা, আমরা কবিতা লিখে তো এই সমাজ সংসার সব কিছু উদ্ধার করে দিচ্ছি না। অবস্থাগুলোকে তো পালটে দিতে পারছি না…

অমিতাভ- আমার যেটা মনে হয়, প্রতিষ্ঠান…, ঠিক আছে…, আমরা যে কাজগুলো করি, যে ধরণের লেখালিখি করি…। আমি যদি মনে করি আমার একটা চাকরি দরকার, তাহলে চাকরি নিয়ে আমার একটা তৃষ্ণা তৈরি হয়, আমার একটা চাহিদা একটা প্রত্যাশা বাড়ে। কিন্তু যদি মনে করি, না আমার চাকরির দরকার নেই, ব্যস্, তাহলে আমার ওই ইচ্ছা, প্রত্যাশা আর থাকবে না…

উমা- একদম ঠিক কথা। আমি আমার মত করে লিখব, তাতে প্রতিষ্ঠান কী চোখে চাইল, নিল কি নিল না এসব কিছুই ম্যাটার করে না…

অমিতাভ- কিস্সু যায় আসে না। আমি চাকরিটা করব না, এই আরকি। আমার প্রতিষ্ঠান ফতিষ্ঠান কিচ্ছু দরকার নেই।

প্রশান্ত- আবার প্রতিষ্ঠান থেকে কে সুবিধা নেয় নি বলো? তুমি নামগুলো পরপর সাজাও, দ্যাখো…

অমিতাভ- সুবিমল বসাক থেকে শুরু কর। কত শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন, আরও কত কিছু, রমানাথ রায়, আবার পরবর্তীকালে তারা মনে করলেন, তারা ঢুকে গেলেন, কই তাদের তো অসুবিধা হয় নি। আসলে আমরা মনে করি প্রতিষ্ঠান মানে একটা অফিস, আর তার মধ্যে বসে থাকা কিছু লোকজন, তাদের নাম। কিন্তু তার বাইরেও কিছু আছে। তারা ব্রহ্মা বিষ্ণু হতে পারেন, কিন্তু মহেশ্বরও একজন আছেন। যাকে বলে মহেশ্বর। হয়ত সল্টলেকে কোথাও একটা থাকেন, তারা স্ট্রেট-ওয়ে আসেন না, তাদের বোঝা যায় না, সরাসরি চিনতে পারবে না। কিন্তু তারাই মহেশ্বর, সপ্তাহে সপ্তাহে কবিতা পাঠের আসর বসে, তুমি সেখানে যাও, তার নজরে থাক, তাকে তুষ্ট কর, তোমার কবিতা, কবিতা সমগ্র রাখো, You will get some benefit, হ্যাঁ বেনিফিট। তুমি পেয়ে যাবে… তারা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নেই, তুমি বলতে পারবে না…

উমা- তার মানে এখানেও অদ্ভুত একটা খেলা আছে…

অমিতাভ- হ্যাঁ খেলা আছে…

প্রশান্ত- তার মানে আমরা কবিতা লিখে এই সমাজ এই ব্যবস্থা পালটে ফেলতে পারব না। কই একটা যুদ্ধ তো আটকানো গেল না, সন্ত্রাস তো আটকানো যাচ্ছে না, পৃথিবী তো আদর্শগতভাবে বদলে যাচ্ছে না…

উমা- রাশিয়ায় মায়াকোভস্কি কবিতায় বিপ্লবীদের এত উদ্বুদ্ধ করল, কিন্তু পরিণামে তাকেও আত্মহত্যা করতে হয়েছিল…

প্রশান্ত- কেন গোর্কি? তার মা… । কী হল?

উমা- সেই বলছি পাবলো নেরুদা পারেননি, নাজিম হিকমত পারেন নি, আমাদের রবীন্দ্রনাথও পারেন নি…

প্রশান্ত- না, পারেন নি তো। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ হতে পারে, প্রাণিত হতে পারে, কিন্তু অবস্থার বদল কিছু করতে পারে না।

অমিতাভ- এটা তো কবির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, কাজের মধ্যে পড়ে না…

প্রশান্ত- ইয়েস, কবির দায়বদ্ধতা এখানে নেই। তাহলে সে স্বাধীন থাকবে না কেন? প্রতিষ্ঠান তাকে কী দিতে পারে, কতটুকু দিতে পারে…

অমিতাভ- Poet is not for change….। সমাজ বদলের দায়িত্ব তার নয়…

প্রশান্ত- তাহলে আমরা একটা জায়গায় আসতে পারি, যে নিজের মত করে কাজ করে যাওয়া, স্বাধীনভাবে… মুক্ত চিন্তা-ভাবনায়… সময় ঠিক করবে কারটা গ্রহণীয় কারটা নয়… আর একটা প্রশ্ন উঠবে—সাহিত্য তাহলে কী জন্য?

অমিতাভ- তাহলে তো এ প্রশ্নও উঠবে, এই যে সব পেইন্টিংস, ভাষ্কর্য, সিনেমা, ইণ্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল মিউজিক এসব কিসের জন্য? কী পালটে ফেলছে সব? কোনও শালা তো বলছে না, এই তোমরা কী করছ? সব দায় কর্তব্য কি কবি সাহিত্যিকের? তা হতে পারে না।

প্রশান্ত- ঠিক ঠিক, ব্যক্তির আনন্দ মজা উন্মেষ মুক্তি এবং বাঁচা এসবের জন্যই সাহিত্য।

অমিতাভ- নে হয়েছে, অনেক হয়েছে, এবার বন্ধ কর। এবার কবিতা হোক।

উমা- ঠিক। প্রচুর আড্ডা হলো দুটো দিনে, দুটো বেলায়, এবার কবিতা পড়া হোক। তোমার বেশ কয়েকটা কবিতা পড়ে আমাকে একটা গদ্য লিখতে হয়েছিল, আমি সেটা পড়ব। না, আলোচনা না। স্রেফ একটা গদ্য।

প্রশান্ত- খুব ভালো। আমার খুব ভালো লাগল। আমার তো এমন হয়না। তুমি তবু মাঝে মাঝে প্রদীপের সঙ্গে আড্ডা মারো। আমার তা হয় না। তাই তো ছুটে এলাম…

উমা- এটা ঠিকই। এর জন্য সব কৃতিত্ব দীপঙ্করের। সেই উদ্যোগ নিয়ে সবাইকে ফোন করে, ইনবক্সে লিখে তাগাদা দিয়ে এই আড্ডা বা আলোচনার ব্যবস্থা করেছে। আমরা বরং ওই সম্পাদকের কাছে কৃতজ্ঞ থাকি।

অমিতাভ/ প্রশান্ত- ঠিক ঠিক। একদম…।

প্রশান্ত- আবার যে কবে…

(এর পরে আরও কিছুক্ষণ সময় ধরে উমাপদ অমিতাভ মৈত্রর কয়েকটি কবিতা পড়ে, এবং সঙ্গে গদ্যটিও। যেটি পরে ঐহিক ওয়েব-ম্যাগ এ প্রকাশ পায়। বেশ কয়েকটি করে কবিতা পাঠ করে অমিতাভ মৈত্র, উমাপদ কর আর প্রশান্ত গুহমজুমদার। কবিতা নিয়েও কিছু কথাবার্তা হয়। ঘড়িতে বাজে দুপুর ১-৩০। উঠতে হয়। দুপুরের খাওয়া সেরে প্রশান্ত গুহমজুমদারকে আজ সন্ধ্যার ট্রেনে মালদা ফিরে যেতে হবে।)