17 Dec, 2016 * Editor: Dipankar Dutta * Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in * Mobile: 9891628652 * Delhi

Dipankar Dutta is no more. We pray that may his soul rest in peace.

রমিত দে



ফেরার চোখ নিয়ে তাকাই আলোক, তোমার না ফেরার দিকে


''আমরা দুজন বাড়ি ফিরছি খেলাপাগল
হাস্নুহানা এনেছি ওই মল্লিকাফুল
আকাশ জুড়ে তারার বাগান
বাড়ি ফেরার কথা আমার মনে আছে ? তোমার মনে?
আধো আঁধার ভরে আমরা বাড়ি ফিরছি
অনন্ত রাত আমরা দুজন বাড়ি ফিরছি ।'' ..........................বাড়ি ফেরা, খেলার সময়

অথচ এই আলোক সরকারই বলতেন- ''আমি কখনো বাড়ি থেকে পালিয়ে যাইনি, কেউ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েও দেয়নি আর বলার দরকার নেই কোনোদিন বাড়ি ফিরে আসাও হয়ে ওঠেনি আমার-বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য পিছন থেকে কোনো ডাক আজও শুনতে পেলুম না। এই শুনতে না পাওয়ার, এই বাড়ি ফিরে না আসতে পারার একটা রং আছে, ময়লা ছায়াছায়া চারদিকে ছড়িয়ে এলিয়ে পড়া রঙ।''- ফেরা না ফেরার এমনই নাছোড় দ্বন্দ্বে আলোক সরকারের সাথে আমার নীরব কথাগুলি। অথচ তাঁর সাথে ফোনে কয়েকবার বার্তালাপ ছাড়া তেমনভাবে পরিচয় তো প্রায় ছিলনা, তবু কেন মনে হয় তাঁর হাত ধরে সাজঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশের গলিগুলো খুঁজছি, সব ফাঁকা সব স্তব্ধ, সাজঘরের দরজা খোলা অথচ আমি যেন খালি পায়ে ঘর থেকে ছুট্টে বের হব বলে এমুহুর্তে তাঁরই সাহায্যপ্রার্থী। হয়ত এই সাদা কালো আলোকচিত্রে আপনিও আছেন কোনো সামান্য নিভৃত পথচারিণী হয়ে। বহুদিন ধরে ভেবেছি তাঁকে নিয়ে কিছু লিখি, হোক না সে মূক হিম নির্বাক কেবল বিস্ময়, তবু তো কিছু, কেবল এই অন্বেষায় কখনও ভিত কেটেছি তাঁর বাড়ির যদি বস্তুজগতের ভিতর দিয়ে পাওয়া যায় তাঁর সেই প্রথম বিশেষকে, আবার কখনও কোনো শান্ত মেঘের মত মেয়ে পিছুপিছু চিনতে গিয়েছে তাঁর নদীর ভাষা, তাঁর আম কুড়োবার গন্ধ। আশ্চর্যভাবে প্রতিবারই আকাশে চাঁদ ওঠেনি পুরোটা। প্রতিবারই হয় আলোক সরকার হাতদুটি ধরে বলেছেন তাঁর বাড়ির মুখ নদীর দিকে হোক, দক্ষিণ দিকে হোক লম্বামত বারান্দা যাতে খুব বেশি রোদ না এসে পরে আর বারান্দার ঢলুনির ঠিক মাঝখানে হোক কিছু ফুল, কিন্তু সে ফুল একটা রং দিয়ে না, দু তিনটে রং দিয়ে তৈরী করো, যাতে একটা রঙের আভা অন্য রঙে ম্লান হতে হতে ঢুকতে পারে। এবং যথারীতি আমি পারিনি রং দিয়ে রং মিলিয়ে মিলিয়ে অমন এক নির্মেঘ আত্মীয়তাহীন সঙ্গহীন নির্জন এক রঙে পৌঁছতে, ঠিক যেমন মেঘের মত মেয়েটিকেও আলোক সরকার থামিয়ে দিতেন তার বেঁচে থাকার অভ্যেসের মাঝে একটা বিরামের স্তব্ধতায়; নিস্পন্দ নিশ্চিত কোলাহলহীন করে তুলতেন তাকে। ডেকে ডেকে বলতেন- ‘আগেকার মতো অতো দৌড়ে হেঁটো না/ এখন তো আর জামা-পরা বালিকা নও/ এখন শাড়িতে পা আটকে যেতে পারে/ তোমাকে দেখবার জন্যে যে দিঘল স্রোত পাড়ে আছড়ে আছড়ে পড়ে তাকে দেখতে দাও/ দেখো চারিদিকে বড়ো-বড়ো চোখ সব তোমাকে দেখতে চায়/ তুমি অতো দ্রুত গেলে হবে না তো”- ঠিক এভাবেই আমাদের থামিয়ে আলোক সরকার ফিরে গেলেন। কেউ বলবেন মৃত্যুলোকে কেউ বলবেন দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে। আমি বলি তা কি করে হয় ! কি করে তিনি হারিয়ে যাবেন ! তিনি তো হওয়ার দিকে যাওয়ার কথা বলেছেন। আসলে তাঁর এই হওয়া ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া নয়, এ সেই হওয়ার প্রস্তুতির কথা যেখানে না হওয়ার কথা হচ্ছে।

তার্কিক এবং তাত্ত্বিক- তাঁর কবিতার প্রতিটি চলাফেরায় এমন কথা একবাক্যে মেনে নেওয়া যেতে পারে অথচ শেষদিন অবধি তিনি যেন নিজে সেই শিশু গাছ যা সম্পূর্ণ গাছ হয়নি। বলা ভাল হতে চাননি। তার হয়ত একটাই কারণ সৃষ্টি এবং স্রষ্টার মাঝে বিশ্লিষ্ট হতে হতে, পরিচয় ও অপরিচয়ের মাঝে ঘোর ঘোর থাকা না থাকার গভীর সেই মহাজাগতিক দরজাটার সামনে এসেও তাঁর ফিরে ফিরে যাওয়া। তিনি কুড়িয়ে নেননি মাড়িয়ে দেননি পুরোপুরি কোনো উপস্থিতিকেই। তাঁর সঞ্চয় শর্তহীন অপ্রকাশটুকুই। যখনই তাঁর বর্ণগন্ধের মুক্তাঞ্চলে প্রবেশ করতে চেয়েছি কিংবা তাঁর নির্ভার অজস্রতার মাঝে কাটাতে চেয়েছি দু'একটা নির্জন দুপুর তখনই বুঝেছি আমি তাঁর মনের মত নদীর দিকে মুখ করা রোদ না পড়া বাড়ি তো বানিয়েছি, দু'একটা পাতায় ধুলোটুলো মাখা ফুলগাছও লাগিয়েছি, কিন্তু কোথাও যেন খুঁজে পাইনি সেই সাদা রঙের দেওয়াল, যে দেওয়াল ভাঙলেই একটা সাদা রঙের সিঁড়ি কিংবা পাতালপথ। আলোক সরকার কখনও বলে যাননি ঘুরে ঘুরে সে পথ নেমে গেছে ঠিক কোথায় কতদূর। কেবল নেমে গেছে। আসলে উনি বলে যাননি তা নয়, ব্যাপারটা হল আমরা সবাই যেন তাঁর কবিতাকে আলোর সামনে ফেলে দেখতে চেয়েছি, শব্দ করে বোঝাতে চেয়েছি, স্পষ্ট আরও স্পষ্ট, উজ্জ্বল সুতীব্র কোনো প্রার্থনা থেকে। কিন্তু আলো কি সবটুকু দেখাতে পারে, সে যা দেখায় তাও তো আসলে সম্পূর্ণ স্থিতি নয়। অথচ রোদ্দুর নিয়ে কবিতা লিখতে বসে তিনি যে ছাদের কার্ণিশের খুব ফিকে একটা চুপচাপকে স্পর্শ করেছেন, স্পর্শ করেছেন সেই অস্থিতিকে। তাঁর মাটি ধূলো উড়িয়ে শব্দ করেছে, তাঁর ফুল রঙ ঝরিয়ে শব্দ করেছে,  হৈ হৈ কোলাহলের মধ্যেই নিঃঝুম দাঁড়িয়ে যা সেই তাঁর শব্দ। তিনি বলতেন ‘শিল্পের সাধনা মিথ্যের সাধনা’। যা কিছু অর্জন তা মনের মধ্যে রেখে দিলেই যে ধূলো পড়বে, আর তখনই আনতে হবে অনুপস্থিতির রুমাল, ঝেড়ে দিতে হবে সবটুকু সত্যকে যাকে সুন্দর করে সাজিয়ে চারপাশের এই বস্তুজগত সত্য বলে নিজের বলে সাঁঝসকালের বন্ধু বলে এক পা বাড়িয়ে গল্প করতে বসেছে। আলো কে আলোক সরকার যেন সবসময়ই কেবলমাত্র সত্যের প্রস্তুতি ভেবেছেন যার অনেক আগে দরকার অন্য এক মিথ্যের প্রস্তুতির। আর এই মিথ্যেটুকুই আলোক সরকারের উপাসনা, জাগতিক সীমাবদ্ধতাকে বিযুক্ত করে অনুভবের ষোড়শ উপাচার নিয়ে তিনি এই উপাসানায়। আবেগ অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমশ সরে এসেছেন পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে এবং সেখান থেকে ধীরে ধীরে অন্তঃসারের ঈপ্সিত বর্ণটির উঁচু গলার ডাক এসেছে। তাঁর যাবতীয় নতুন আসলে আলো থেকে রোদ্দুর থেকে সরে আসার নতুন, তাঁর যাবতীয় ভাবনা আসলে সূর্যকে আড়াল করার মত একটা ঢাকনার ভাবনা, তাঁর যাবতীয় অন্বেষণ অন্ধকারের, তাঁর যাবতীয় খেদ ‘একটা অন্ধকারও আলোচনার বিষয় হল না কেন’! অথচ তিনি তো একজন আস্তিক মানুষ, তবে এ কোন অসহয়তা কিংবা সহজিয়া আত্মনেশা তাকে আলোড়িত করে তুলল? তিনি নিজেই বলতেন- “আলো যত কিছুই দেখাক না কেন, কখনো অন্ধকারকে দেখাতে পারবে না। আলোর প্রতি উদ্ভাসের ভিতর এই অসহায়তাকে চিহ্নিত করো, সেই পাষাণ নিঝুম কান্নাকে। …… যা আছে তা হয় অন্ধকারের পোশাক গায়ে জড়িয়ে আছে কিংবা আলোর সত্যদৃষ্টির সন্মুখে আছে। আলোর নিজস্ব কোনো পোশাক নেই, আলোর কেবল সত্যকে বলার দায়, সেই সত্য যা অর্ধসত্য, অতীত হারানো স্বপ্ন হারানো বর্তমান। অন্যদিকে অন্ধকারের নিজের কোনো সাজ নেই, সে কেবল একটা সমগ্রকে বলে, তার সাজঘরে একটাই অতিরিক্ত রং, নিরপেক্ষ রং।‘-

আর এই অন্ধকারের সাথে মোলাকত করাতেই যেন আমাদের এত দিনের পরিচিত পথটাকেই একেবারে অপরিচিত পোশাকে জড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ভিক্ষাভাষায় আলো অচেনা, হাওয়া অচেনা, পথের ছায়া পথের গন্ধ সবই অচেনা, সবই শব্দ না করা, কথা না বলা আবছা ছায়া মাখা অসংযোগ। আর এভাবেই আমাদের চিরদিনের প্রচল কাব্যপাঠের অভ্যেসকে একধরনের নিঃশব্দ প্রতিবাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিবাদ কোনো হওয়ার জন্য নয় বরং সেই গোপন অনিবার্য না-হওয়ার প্রতিবাদ। তিনি যে বাইরে থেকে কিছু নেননি তাও নয়। প্রভাতবেলার পুরোটা কিংবা লালফুলগুলোর পুরোটা কিংবা লুকোনো কথা আর খোলা সাজের আর ছেঁড়া মালার পুরোটাই তিনি নিয়েছেন অথচ এই নেওয়াকেই ভিতরমহলের না নেওয়ার সাথে মিথুনভাবে সম্ভোগ করিয়েছেন। আর জীবত্ব থেকে অনায়াসেই পৌঁছে গেছেন আশ্চর্য এক শিবত্বে। পুরুষ যদি প্রকৃতিকে অনুসরণ করে তাহলে তার অবসাদ অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সে যদি প্রকৃতিকে অন্তরে আকর্ষণ করে নেয় তবে আর অবসাদ দেখা যায় না। কারণ আকর্ষণ করে নিয়ে তাকে শূন্যে মিলিয়ে দিতে পারলেই তা হয়ে উঠবে প্রত্যাহার। যেমন একটা হলুদ রোদ্দুরকে আলোক সরকার দেখলেন সে হেলছে দুলছে পালাচ্ছে আর সাথে সাথেই দুপুরবেলার ভূত কিংবা বুড়ো নিমগাছ হয়ে হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন সে রোদ, তাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে তার সাজকে করে তুললেন সীমাবিহীন এক সংস্কার। এবার তার ভেতর যে আনন্দরূপ রয়েছে সে এখন সত্যিই নীরূপ, আসলে ওই রূপ এখন রস, বিশুদ্ধ রস। আবার যে দশজন মনখারাপ ঝিমুচ্ছে তাদেরকেই ফুটফুটে খই রঙের রোদ্দুরে বা লাল হলুদ বৃষ্টিতে ভিজিয়েছেন কিংবা যে কালো কোকিল লুকিয়ে কাঁদছে তাকেই মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন একরাশ হলুদ ফুলের খিলখিল হেসে ওঠার সাথে। ঠিক এতটুকুই ছিল আলোক সরকারের জাগ্রত প্রস্তুতি, সারাসময়ের জেগে থাকা, কারণ এই জেগে থাকাই একমাত্র স্বপ্ন আর সুযুপ্তির মাঝের সেই গভীর অবশ্যম্ভাবী সত্যকে চেনাতে পারে। আলোক সরকার যেন জানতেন এই নিয়মনির্ধারিত জাগতিক প্রেক্ষাপটে যা কিছু মিথ্যে তাকে পেতে গেলে চাই এমনই একটি নির্নিমেষ জেগে থাকা; ফলে প্রকৃত আভরণের বাইরে যেটুকু অপরিকল্পনা যেটুকু অন্ধকার তাই হয়ে উঠেছিল আলোক সরকারের একান্ত আপন, সেখানে সামান্য ছায়ার বন্ধুতাও কিছু কম নয়। আসলে ছায়া বলতে আমরা যাকে বুঝি সে হল প্রতিচ্ছায়া। ‘ছন’ ধাতু থেকে এসেছে আর একে ঋগবেদে অনেক জায়গায় ঊষা সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে ‘ছন’ এর অর্থ হল অন্ধকারের ভেতর থেকে ফুটে ওঠা। আবির্ভাব। আলোক সরকারের ছায়া আসলে এমনই এক আলো যাকে বাইরের আলো দিয়ে দেখা যায় না, অথচ তার আলোতে সমস্ত আভা পায়। যেন বারবার এই ছায়াকেই পেছন থেকে ডাক দিয়েছেন, উঁচু করে দেখতে চেয়েছেন তার ভেতর লুকিয়ে থাকা আলোর সেই সাহজিক বিরাম।

আসলে যে জীবন সার্থকতার মাঝে প্রোথিত সেখানে শেষমেশ এক রহস্যদেঊলই আলোক সরকারের প্রস্তুতিভূমি –সমস্ত জীবন, সমস্ত চরাচর, সব সুখ দু;খ ব্যপ্ত এক নিশ্চয়তার ভূমিতে দাঁড়িয়ে তাঁর চিন্তা ভেঙেচুরে সেই নতুনকে পাওয়া, যেখানে সারাদিনের রোদ্দুর রাত্তির অন্ধকারে একা ভিজছে, যেখানে মালী দেখতেই পেল না চুপিচুপি কিভাবে গাছে উঠল একটি চুরির নিস্তব্ধ আর পাতা মাড়িয়ে চলে গেল হাওয়া, যেখানে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল বলে কাউকে পাঠানো হল কালো অরণ্যে কিংবা যেখানে পাতা ঝরার শব্দ হতেই মনে হল পায়ের শব্দ ঢাকা পড়ল, ঠিক এমনই সব নতুনের ছবি আলোক সরকারের মৌলিক ভাষায়। ২০১০ এ দিয়া থেকে যখন আলোকদার কাব্যসমগ্রের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হল, তখন প্রকাশকের নিবেদনের প্রথম বাক্যটাই ছিল ''কবি আলোক সরকার বহমান সময়কালের অন্যতম প্রবীণ কবি''। আজ তাঁর মৃত্যুর পরও বাংলা কাব্যজগতে ঋষিবাক্যের মতই তাঁর এই প্রবীনতা চিরসত্য। কিন্তু এই প্রবীণতার মধ্যেই বিপুল এক অপরিচয়। অলীক ভাস্করের মত ভাষা খোদাই করে তুলে এনেছে তাঁর মধ্যেকার সেই চিরবালককে। শিল্প যেখানে বিমূর্ততা, শিল্পী যেখানে অভিজ্ঞতায় জারিত সেখানেই আলোক সরকার সৃষ্টিকে সারল্যের নিরিখে মাপতে  চেয়েছেন। সরলতাই ছিল তাঁর কবিতা রচনার প্রথম শর্ত অথচ যে কোনো আলোচকের কাছেই হয়ত প্রাথমিকভাবে তাঁর কবিতা বৌদ্ধিক, পার্থিব চেতনার থেকে লোকোত্তরে উৎক্রমিত। কিন্তু অক্ষরের যে সরলতা যে স্তব্ধতা তাঁর চেতনজগতের মূলে, সেখানে অন্তরাবৃত্ত বোধের দ্বারা আমাদের অবগাহন করতে হয়। এই সরলতায় পৌঁছোবার সবচেয়ে সহজ পথ হল দৃশ্য যেখানে থেমেছে, যেখানে সে আর কোনোদিনও যাবে না সেখানেই উঁচু আরো উঁচু স্বরে একটা অদৃশ্য পথের একটা অশ্রুত গানের ভাষা খোঁজা, এই যে যেখানে প্রকৃতির সবটুকু থেমে যাওয়ার কান্না সেখানেই তার ভিতরের মাটির তলা অবধি নেমে গিয়ে খোঁজা উচিত আনন্দের অলক্ষ্য কারুকাজ। আলোক সরকার বলতেন- ''আনন্দময় যন্ত্রণার সাধনাই শিল্পীর সাধনা। ব্যবহারিক অর্থে আমরা যাকে দুঃখ বলি, বেদনা বলি, হতাশা বলি, সেই রকম কোনো দুঃখ-বেদনা-হতাশা শিল্পীর নেই। অমূর্ত শিল্প, অমূর্ত সৌন্দর্যের অন্তহীন রহস্যাবগুন্ঠনের যে বেদনা সেই বেদনা শিল্পীর বেদনা। পার্থিব দুঃখ একটা প্রেরণামাত্র। কবিতার রহস্য সম্পূর্ণ সরল মানুষের আকুতি। ... আদিম মানুষের শিল্প জন্ম-কেন্দ্রিক অথবা জীবন-কেন্দ্রিক। জন্ম-জীবন সৃষ্টি; মৃত্যুকে অতিক্রম করবার সোপান, নির্জনতাকে অতিক্রম করবার সোপান। সেই সিঁড়ি শেষ পর্যন্ত শিল্পীকে এমন এক তন্ময়তায় রাখল যেখানে মৃত্যু নেই, পার্থিব অর্থে জীবনও নেই, জীবনের গভীরতম উপলব্ধি আছে, সম্পূর্ণ সরল মানুষ আছে-'' এই সেই আলোক সরকারের দ্বিতীয় পৃথিবী, তাঁর আলোকিত বিস্ময় আলোকিত নিঃসঙ্গতা। সারাটা কাব্যজীবন ধরে আলোক সরকার যেন এই সাদা থাকার মধ্যেই নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন, স্কুল ছুটির পর দক্ষিণে ল্যান্সডাউন রোড আর শরৎ ব্যানার্জ্জী রোডের বাঁদিক ডানদিক করতে করতে যখন ঢাকুরিয়া লেক পার হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই ঝুলন্ত দ্বীপের কাছে যেখানে শান্ত বিষন্ন ফুল দিয়ে সাজানো যেখানে টলমল করছে কোনো দীর্ঘ প্রতীক্ষা কিংবা অনন্তকালীন নিস্তব্ধতা সেখানেই সাদা লাল সন্ধ্যামালতীর পাশে দাঁড়ালেই মনে হয়েছে বাড়ি পৌঁছে গেছেন, মনে হয়েছে এর পর কেবল ছোটো ছোটো সরু নৌকা আর কোলাহলহীন স্বচ্ছ জলবিস্তৃতি ছাড়া থাকা বলতে আর কিছু নেই। আবার সত্তোরউর্ধ্ব কবি লিখলেন- ''পুরোটা কখনও হয়ে ওঠে না/পুরোটার দিকে যাওয়া হয়/ একটু আগে লাল হচ্ছিল/ এবার গোলাপি হচ্ছে/চার পাঁচ ধাপ ওঠার মধ্যেই /সাদা ঠান্ডা/ একটা ওঠা নামা/তার মধ্যেই কতবার সাজ বদলান/ সাজবদল কখনও সবটা হয়না/ সে বাঁদিকে ডান দিকে/অনেকগুলো যাওয়া রাখবেই'' - এই সেই আলোক সরকার যিনি যতটা সম্ভব অনতিক্রমনীয়কে অতিক্রম করতে চেয়েছেন, নেমে যেতে চেয়েছেন শ্লথ নিবিড় অস্পর্শের একেবারে ভিতর অবধি, যেখানে তাঁর কোনো বাহ্যিক সতর্কবার্তা নেই, সংযুক্তি নেই কেবল অগণন উদ্দেশ্যহীন এক আনন্দউদ্ভাস।

জড়বাদ আর চিদবাদের আশ্চর্য এক সম্বন্বয় আলোক সরকারের চিন্তনে। অণুর সর্বত্র ব্যপ্ত হতে চেয়েছেন। এমনকি পূর্ণ শূন্যের বিন্দু চেতনা থেকেও পৌঁছোতে চেয়েছেন নতুন কোনো প্রাণময় কোষে। অক্ষরে অক্ষরে তুলে আনা এত যে ছবি তার মধ্যে এত চেনাজানা এত হাসিমুখ তাদের যেমন ডেকে ডেকে বলেছেন এসো আমার ছাতার তলায় এসো, এখানে কোনো উঁচু ডালের ফুল নেই, কাঁটার কামড় নেই, মাটির ধূলোমাখা নেই, কেবল দরজা খুলে সম্ভাষণের দুবাহু এগিয়ে দেওয়া আছে, সেখানেই আবার দরজা জানলা খুলে দিতেই মৃদু বিদায়ভাষণ জানিয়েছেন এই প্রিয় জড়ব্রহ্মকে। ঠিক যেন ঘুরতে ঘুরতে যেখানে বিকেল নামল সেখানেই দিনের শেষদিকে তাঁর নতুন পথচলা শুরু হল। থাকা আর দাঁড়াল না। ফেরা আর হলনা। দু হাত উঁচু করে থাকা খুঁজতে বেরোলো তার না-থাকাকে। আর এই পার্থিব ভালোবাসায় দাঁড়িয়ে, নিয়মী নদী আর প্রবীণ পাথরে দাঁড়িয়েই জানলা খুলতে খুলতে বিড়বিড় করে কেউ যেন বলে উঠল- ''পিছন দিক থেকে/সজোরে ধাক্কা দিতে/একদিন/জানলা খুলে গেল।/ এ কোন দেশ/এত বড় অপার্থিবর সঙ্গে /এত দীর্ঘদিনের/বসবাস!”—কতবার কত মানুষের নাম তৈরি হল তাঁর মুখে, কত গাছের কত নদীর কত পাখির, ফলের বিচি থেকে ফুলের ঝরে যাওয়ার ছবিও তৈরি হল, কিন্তু সত্যি কি তাঁদের হাত ধরে তিনি বাড়ী ফিরতে পেরেছেন নাকি হাত ছাড়িয়ে চলে গেছেন নতুন কোনো দরজার দিকে! সেজেগুজে বসে আছে এমন নতুন কোনো জানলার দিকে! আজও মনে হয় সত্যি কি একদিনের জন্য হলেও বাড়িতে ফিরে আলোক দার মনে হয়েছিল তিনি বাড়িতে ফিরেছেন? ক্ষয়ে আসা ভেঙে পড়া আয়ুর প্রান্তে এসেও সত্যি কি এত চেনা চেনা হাসি আর ভীড় ভীড় ভাষাকে তিনি বলতে পেরেছিলেন আমি তোমাদের চিনেছি? আসলে পুরোটা চিনেও তাঁর নির্বাচন যে শেষমেশ একটা না-চেনার যন্ত্রণার। পুরোটা ফিরতে চাননি তিনি। বাস্তবত অনুপস্থিতির সন্তান তাঁর সৃষ্টিরা। আর এক অনতিক্রম আঁধারচক্রেই রচনা করেছেন তাঁর আত্মলোক। তাঁর নিজস্ব বাগানে সারি সারি হারিয়ে যাওয়া আর সারি সারি খুঁজে পাওয়ার সখ্যতা, যেখানে আবছা অন্ধকারে ঠিক কোনো না কোনো একটা আঙুল ধরে চলে এসেছেন বারেবারে এবং তারপর যথারীতি কাউকেই বলা হয়ে ওঠেনি ‘আর একদিন এসো’।